“গঞ্জের জমিদারসঞ্জয় সেন দু মুঠো অন্ন তারে দুই বেলা দেন।” সহজ পাঠে পড়া কবিতায় যে গঞ্জের ছবি চিত্রপটে ভেসে উঠত, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধনেখালির সাথে তাকে মিলিয়ে ফেলেছিলাম মনের অজান্তে।সেকালে ধনিয়াখালী ওরফে ধনেখালী ছিলো একটি গঞ্জ। ‘গঞ্জ’ শব্দের সাধারণ অর্থ ধন-সম্পদের ভাণ্ডার বা গুদাম। এর অন্য অর্থ বাজার বা ছোট শহর ,যেখানে বিভিন্ন পণ্যের আড়ত বা গুদাম থাকে। ধনেখালী ইংরেজ আমলে বা তৎপূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল ছিল। এখানে নীলকুঠিরও অবস্থান ছিল। সেই বিশাল গঞ্জ আর নেই। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বড়ো বাজার,বড়ো শপিং মল গড়ে উঠেছে। চাষির দল এখন গরুর গাড়ির পরিবর্তে মোটর গাড়িতে পসরা নিয়ে যায়। এই গরুর গাড়ির পাট উঠে গিয়েছে বহু আগেই।
সে যুগে ধনিয়াখালীতে ‘খইচূর’ নামের এক প্রকার খইয়ের তৈরি বিখ্যাত মিষ্টি পাওয়া যেত। প্রায় ৫০ প্রকারের মশলা সহযোগে এই মিষ্টান্ন তৈরি হত। ধনিয়াখালী এই মিষ্টান্নের জন্য বিখ্যাত ছিলো। সুধীরকুমার মিত্রের ‘হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ’ পড়লে জানা যায় শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেব এই মিষ্টি খেয়েছিলেন। এখন আর এটি ধনিয়াখালীতে পাওয়া যায় না। ধনিয়াখালী মাছ ধরার বঁড়শীর জন্য বিখ্যাত, এখনো ধনিয়াখালির বাজারে এই বঁড়শী পাওয়া যায়। সেকালে বঁড়শী কেনা, রথযাত্রা ও রাস উৎসব দেখার জন্য ‘কু ঝিক ঝিক’ করে ছুটে আসা বি পি আর রেলগাড়িতে পা রাখার জায়গা হত না। তারকেশ্বর-ত্রিবেণী বি পি আর রেলপথের একটি স্টেশন ছিল ধনিয়াখালীতে। রথযাত্রা ও রাস উৎসব এখনো হয়, শুধু বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই বি পি আর রেলপথ। একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বি পি আর রেলপথ জন্য ৪টি নদীর উপর তৈরি করা পুল এখনো তার স্মৃতি বয়ে চলেছে।
এককালে বহু দূর দূরান্তের দেশ থেকে সওদাগড়রা বাণিজ্য করতে আসতেন ধনিয়াখালি গঞ্জে। সেই সময় এই গঞ্জে প্রচুর জনসমাগম হত আর ধন-দৌলতের গঞ্জ ছিল ধনিয়াখালী। হতে পারে এই অর্থই ধনিয়াখালী নামের সার্থকতা। এখানের তাঁতের শাড়ি কাপড় ধুতি বিখ্যাত। অতীতকালে সুশি ও শিশক্কর নামে একপ্রকারের লুঙ্গি জাতীয় রেশমের কাপড় তৈরি হত। এই কাপড় লাক্ষা দ্বীপ ও মালদ্বীপে রফতানি হত। বর্তমানে সুশি ও শিশক্কর লুঙ্গি তৈরি করা বন্ধ হয়ে গেছে। এই গ্রাম ও আশেপাশের গ্রামগুলি তন্তুবায় প্রধান। এলাকার প্রসিদ্ধ মন্দির ও প্রতিষ্ঠান গুলির বেশির ভাগ তন্তুবায় জাতীর ব্যক্তিগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত।
শুধুমাত্র বি পি আর রেলপথ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নয়। বরং ধনিয়াখালী বাজারের সমৃদ্ধি ও পূর্ব গৌরব হারানোর পিছনে তাঁতশিল্পের অধঃপতন এর সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী নতুন বাজার বা গঞ্জের উদ্ভব হওয়াও বড় ভূমিকা পালন করেছে।মাঝেরপাড়ায় হাতে গোনা মাত্র পাঁচটি ঘর বাদ দিলে একটিতেও তাঁত নেই। এক প্রবীণ শিল্পীর আক্ষেপ, “ধনেখালির শাড়ির আদর আজও আছে, কিন্তু বাজার নেই৷ পয়সা না থাকলে শিল্প বাঁচে?” ৯০ থেকে ৫২৫ টাকা পর্যন্ত মজুরি হলেও গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মজুরি পান তাঁতশিল্পীরা৷ বালুচরি শাড়ি বুনলে সমবায় দেয় ৫২৫ টাকা মজুরি৷ কিন্তু তা খুব বেশি বোনা হয় না৷ একটা বালুচরি বুনতে সময়ও লাগে অনেক বেশি৷ সরকারি ভাবে মজুরি বাড়লেও দৈনিক হিসেবে দেখলে তাঁত শিল্পীদের মজুরি মাসে মেরেকেটে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা৷ উপরন্তু তার উপরেও সরকার চাপিয়ে দিয়েছে নানান কর সেরকমই অভিযোগ শিল্পীদের। তাই নতুন প্রজন্ম তাঁতের বদলে রাজমিস্ত্রির জোগাড়, বিস্কুট কারখানায় শ্রমিক, সব্জি বাজারে ডালা সাজানোর কাজ কিংবা দিনমজুরী করে সংসার টানছেন। তাঁতির ঘরের ছেলেমেয়েরা আর তাঁত মুখো হচ্ছে না৷
প্রতিবেদক – তরুণ কোলে
Discussion about this post