উত্তর ২৪ পরগণার ছোট্ট গ্রাম আড়বালিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের নানা অধ্যায়। এই গ্রামের মাটিতে একই পরিবারে জন্মলাভ করেছিলেন দুই কৃতী সন্তান, যাঁরা দেশের তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানকে নতুন দিশা দিয়েছিলেন। একজন ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্রনাথ রায়, তথা নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। অপরজন ছিলেন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের সহযোদ্ধা, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য। বহু সময়ের বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই পরিবার। তবে ইতিহাসের পাশাপাশি, এই পরিবারের ঐতিহ্যের পরিচায়ক তাঁদের সাবেকী দুর্গোৎসবও!
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মিশেল এই বাড়িটি পরিচিত ‘ভৈরব ভবন’ তথা ‘হাঁস ঠাকুরের বাড়ি’ নামে। আগে গ্রামের ‘নীলকণ্ঠ কুঠি’তেই একসাথে পুজো করতেন পুরো পরিবার। সেই পুজো এবছর পা দিলো ২২৫ বছরে। পরবর্তীতে পরিবারের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে আলাদা পুজো শুরু হয় ভৈরব ভবনে। শোনা যায়, তার আগের বছর নীলকণ্ঠ কুঠির পুজোয় প্রতিমা বিসর্জনের সময় পরিবারের এক কনিষ্ঠ সদস্য শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, পরের বছর ভৈরব ভবনে পুজো শুরু হলে ঠাকুরকে দেবেন লজেন্স ও বিস্কুট! পরের বছর মাটির দালান বানিয়ে পুজো শুরু হলে, প্রতিশ্রুতিমতই দেবীকে দেওয়া হয়েছিল সেই লজেন্স ও বিস্কুট ভোগ!
এ বাড়ির পুজোয় বরাবর বংশ পরম্পরা মেনেই আসেন ঢাকিরা। অষ্টমী তিথিতে কুমারী পুজো ও দন্ডীকাটার সাথেই হয় নবদম্পতিদের মঙ্গল কামনায় সুবচনী পুজো। তবে অষ্টমীর অঞ্জলীর মন্ত্রের সুর এখানে কিছুটা ভিন্ন। বহু বছর আগে পুজোয় পাঁঠাবলির প্রচলন থাকলেও, পরবর্তীতে মায়েরই স্বপ্নাদেশে তা বন্ধ হয়। পরিবর্তে বলি দেওয়া হয় চালকুমড়ো। নবমীর দিন বিশেষ চার রকম বলিতে থাকে চালকুমড়ো, আখ, কলা ও শসা। পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ভোগ তো থাকেই, তবে নিরামিষের বদলে দেবীর ভোগে থাকে বিভিন্ন ধরণের মাছ। নবমীর ভোগে থাকে একটি বিশেষ পদ, যাকে বলা হয় ‘অসুরের বড়া’! কথিত আছে, এই বড়া খেলে নাকি অসুরের মত শক্তি হয় গায়ে! আসলে এটি কলা দিয়ে তৈরি হয়। দশমীর দিন বাড়ির মেয়ের কৈলাসে ফেরার পালা! এতখানি পথ যাবেন, তাই সেদিন ভোগে যত্ন সহকারে প্রস্তুত হয় হালকা খাবার। থাকে পান্তাভাত, কচুর শাক, কুচো চিংড়ি ভাজা ইত্যাদি। এছাড়াও নবমীর দিন অনুষ্ঠিত হয় নাটক, সারা গ্রামের মানুষ আসেন তা উপভোগ করতে।
১০৩ বছরের রীতি মেনে আজও ইছামতীতেই হয় ঠাকুর-ভাসান। ঢাকিদের মতই, বংশপরম্পরায় প্রতি বছর আসেন ১৮ জন বেয়ারাও। তাঁদের কাঁধে চড়েই মা ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে পাড়ি দেন প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ। তারপর জোড়া নৌকায় সম্পন্ন হয় বিসর্জন। বহু বছর আগে মায়ের মর্ত্যলোক থেকে প্রস্থানের বার্তা মহাদেবের কাছে পৌঁছে দিতে ওড়ানো হত নীলকণ্ঠ পাখিও। বোধন থেকে বিসর্জন – এ বাড়িতে মায়ের আরাধনার প্রতিটি আচারেই যেন সুস্পষ্ট আন্তরিকতার ছাপ। যে আরাধ্যা দেবীর কাছে আমরা মাথা নত করে আশীর্বাদ চাই, সেই দেবীকেই আমরা বাড়ির মেয়ের মত চোখের জলে বিদায় জানাই। এমন মাধুর্যই তো শারদোৎসবকে করে তোলে এতখানি অনন্য!
Discussion about this post