“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ, তবুও অনন্ত জাগে।” মানবজীবনের একমাত্র শাশ্বত সত্য হল, মৃত্যু। মাইকেল মধুসূদনের কথা খানিক ধার করেই বলা যায়, “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?” অর্থাৎ এ জীবনের শেষ পরিনতি হিসাবে মৃত্যুটাই একমাত্র ধ্রুবক। জীবনে চলার পথের গতি বারংবার বদলে গেলেও, এই একটি মাত্র সত্য বদলাবে না কিছুতেই। নিজের জীবন ক্রমে একটি মানুষ একাধিক মৃত্যুর সম্মুখীন হতে পারেন। নিজের আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবৃত্তের মৃত্যুও নিজের চোখের সামনে ঘটে তাঁর। এ তো গেল সাধারণ মানুষের কথা। আমাদের সাধারণের চোখে যারা মহামান্য ব্যক্তি, প্রায় ঈশ্বরের পরেই আমাদের মনে যাঁদের স্থান তাঁদের জীবনেও কিন্তু মৃত্যু নেমে এসেছে নিত্য-নৈমিত্তিক। মৃত্যুর অমোঘ সত্য থেকে ছাড় মেলেনি তাঁদেরও। তবে এই বিরোহ-যন্ত্রণাই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছিল তাঁদের ভাব প্রকাশের অস্ত্র। এমনই একজন ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আস্তিক হোক বা নাস্তিক, যে ঠাকুরের পুজোয় সামিল হয়েছেন আপামর বাঙালি। সেই তিনিই জীবন কালে নিজের এত কাছের মানুষের মৃত্যু দেখেছিলেন যা মনে হয় এক জন্মে আর কেউই দেখেনি। তবে তার পরও থেমে থাকেন নি তিনি, বরং মেতেছেন নতুন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। আর তাই তাঁর সৃষ্টি সাহিত্যেও ছোঁয়া মেলে সেই গভীর মৃত্যুচিন্তারই।
স্নেহময়ী বৌদি থেকে মা-বাবা, ভাই-বোন, প্রিয়তমা স্ত্রী, প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র-কন্যা, ভাইপো, নাতি সহ আরও বহু কাছের মানুষের মৃত্যুই নিজের চোখের সামনে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মাত্র ১৪ বছর বয়সে মাকে হারান তিনি। মাকে হারানো যন্ত্রণা বেশ গভীরই ছিল। তবে যৌবনে মৃত্যুকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করেন তাঁর প্রাণ-প্রিয় বৌদি কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু দিয়ে। তখন তাঁর বয়স মাত্র চব্বিশ। এরপর তাঁর পরিবারে নেমে মৃত্যুর খাঁড়া। মারা যান তাঁর দুই ভাইপো। যাদের প্রায় নিজের সন্তানের মতই স্নেহ করতেন তিনি। সেই মৃত্যুগুলির কিছু মাস পরেই তাঁর জীবনে নেমে আরেক ভয়ঙ্কর অভিশাপ। মারা গেলেন তাঁর স্ত্রী, মৃণালিনী দেবী। সে যন্ত্রণা কাটিয়ে ওঠার একমাসের মধ্যেও মারা যান তাঁর মেয়ে রেণুকা, এরপ পরের কয়েক বছরের মধ্যে তিনি হারান নিজের বাবা, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র শমীন্দ্রনাথ কে। শুধু এঁরাই নন, এই সময়ের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ হারান নিজের ভীষণ কাছের আরও কিছু মানুষকেও। তাঁর নিজের সন্তান ছাড়াও, দাদা, নাতি এবং কাছের কিছু বন্ধুও ছিলেন সেই তালিকায়। তবে একথাও ঠিক এই প্রতিটি মৃত্যুর পরই কিন্তু গভীর ভাবে শোকাহত হলেও প্রকাশ্যে তা কখনোই প্রকাশ করেননি রবীন্দ্রনাথ। বরং লেখনীর মাধ্যমেই বরাবর প্রতিফলিত হয়ে এসেছে তাঁর যন্ত্রণা, মৃত্যু নিয়ে তাঁর চিন্তাধারা। নিজের মৃত্যু নিয়েও একপ্রকার উদাসীনই ছিলেন তিনি, তবে হার মানতে শেখেননি। তাই তো তিনিই লিখে যেতে পারেন- “আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে/ যাব আমি চলে।” প্রকৃত অর্থেই তো তিনি ছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ী।
বারবার নিজের সাহিত্য বা কবিতার মাধ্যমে তিনি উজাড় করেছেন নিজের গভীর মৃত্যু-শোক। তাঁর বিভিন্ন লেখাতেই পাওয়া যায় সেই প্রমাণ। ভানুসিংহের পদাবলীতে তিনি মৃত্যুকে একপ্রকার আহ্বান করেই তিনি লিখেছিলেন- “মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।” আবার নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থের ‘মৃত্যু’ কবিতায় তিনি বলেন- “মৃত্যু অজ্ঞাত মোর, আজি তার তরে… মৃত্যুকে আমি ভালো বাসিব নিশ্চয়।” তাঁর লেখা গানেও পাওয়া যায় নিজের যন্ত্রণার সেই প্রকাশ, “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।” নিজের ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থেও রয়েছে মৃত্যু ঘিরে তাঁর উপলব্ধির কথা। এছাড়াও তাঁর লেখা নানা চিঠিপত্রেও আভাস মেলে ঢের। জীবদ্দশায় একবার কঠিন এক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখেন- “মৃত্যুর ভিতর দিয়ে ফিরে আসা সকলের ভাগ্যে ঘটে না। যদি ঘটে, তবে অন্তত তখনকার মত অহমিকা শিথিল হয়ে আসে কতখানি স্থায়ী হয় বলতে পারিনে।” কবির ভাবনায় এও উঠে আসে, “জীবনকে সত্য বলে জানতে গেলে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার পরিচয় পেতে হবে। যে মানুষ ভয় পেয়ে মৃত্যুকে এড়িয়ে জীবনকে আঁকড়ে রয়েছে, জীবনের পরে তার যথার্থ শ্রদ্ধা নেই বলে জীবনকে সে পায়নি। যে লোক নিজে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বন্দি করতে ছুটেছে, সে দেখতে পায়, যাকে সে ধরেছে সে মৃত্যুই নয়, সে জীবন।”
আসলে রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনের ওপর এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল মৃত্যু। তাই সেই মৃত্যুর নান্দনিক দিকই খুঁজে বের করতে সারাজীবন উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যু চিন্তাতেও সেই নান্দনিকতা স্পষ্ট। তাঁর কথায়, “জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।” নিজের আসন্ন মৃত্যুরও আভাস পেয়েছিলেন আগেই। তবুও মৃত্যুকে হাসিমুখে তিনিই বলতে পারেন, “এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি। এ ভালোবাসাই সত্য এ জন্মের দান। বিদায় নেবার কালে, এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।” তবে মৃত্যুকে হয়ত এত সহজে অস্বীকার করা যায় না। কবিও পারেননি। একসময় দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ১৯৪১ সালের ২২শে শ্রাবণ, আজকের দিনেই মৃত্যু বরণ করেন তিনি। তবে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে মৃত্যুকে এক অন্য সত্ত্বা রূপে চিনিয়ে গেছেন তিনি। যে সত্ত্বা জীবনেরই অপর রূপ। কারণ কবিই বুঝিয়ে গেছেন, মৃত্যু না থাকলে তো জীবনকে গভীর ভাবে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চাহিদাই শেষ হয়ে যেত। মৃত্যু রয়েছে বলেই আমাদের বেঁচে থাকাটা এত সুন্দর, এত প্রিয়, এতটাই সার্থক। মৃত্যুই জীবনের পরম উপলব্ধি, যা না থাকলে আমাদের বেঁচে থাকাটাও হয়ত এত তাৎপর্যপূর্ণ হত না।
Discussion about this post