স্কুলের আসল কাজ বাচ্চাদের শিক্ষা দান করা। তবে, এই শিক্ষা শুধুই কী পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা? শুধুই কী পরবর্তী জীবনে রোজগার করে সামাজিকভাবে, আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শিক্ষা? তাই যদি হত, তবে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে গাছতলার নিচে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা, শিল্প আর প্রকৃতি শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন না। বর্তমানে, ইঁদুর দৌড়ের যুগে বাবা মায়েরা বলবেন, “স্কুলে পড়াশোনা করবে, নাকি নেচার দেখবে? ওসব সময় নষ্টের দরকার নেই।” কিন্তু, কোনটা ‘সময় নষ্ট’, আর কোনটা সময়ের সদব্যবহার, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ডেনমার্কের স্কুলের বাচ্চারা। আর তাদের থেকেই উপকৃত হয়েছিল আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা।
১৯৮৪ সালে ডেনমার্কে স্থাপিত হয়েছিল সংস্থা ‘অপারেশন ডেইস ওয়ার্ক’। সংস্থার কর্মসূচী ছিল, স্কুলের একটি বিশেষ দিনে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের মত স্কুল শিক্ষার বাইরে কোনো কাজ করবে। সে কাজ গাড়ি ধোয়া থেকে আরম্ভ করে, গান গাওয়া, হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাসন মাজাও হতে পারে। বদলে তারা যে পারিশ্রমিক পাবে, তা দান করা হবে কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে। যারা দুঃস্থ এবং অভাবী মানুষের কাছে সেই অর্থ দান করবে। বর্তমানে ডেনমার্ক শুধু নয়, নরওয়েসহ অনেক দেশেই চলছে ‘অপারেশন ডেইস ওয়ার্ক’।
১৯৯৬ সালে এই সংস্থার দ্বারা উপকৃত হয়েছিল ভারত। মূলত, ভারতের সেই অঞ্চলের মানুষ, যাঁরা বর্তমানে প্রকৃতির জন্য, নিজেদের অধিকারের লড়াইয়ে আমৃত্যু অনশনে। অর্থাৎ, লাদাখ। আর আজকের লড়াই যিনি পরিচালনা করছেন, ২৫ বছর আগেও তিনিই ছিলেন। তিনি সোনাম ওয়াংচুক। সেই সময় লাদাখের শিক্ষার হার প্রায় ছিলনা বললেই চলে। গুটিকয়েক ভাঙাচোরা স্কুলে বাচ্চাদের পাশের হার ৫ শতাংশের কম ছিল। কিন্তু, সোনাম ওয়াংচুকসহ কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ শিক্ষার উন্নতির জন্য তৈরি করেছিলেন ‘অপারেশন নিউ হোপ’। ‘অপারেশন ডেইস ওয়ার্কে’র সেই টাকা ড্যানিশ সংস্থা ড্যানচার্চএইডের মাধ্যমে পৌঁছেছিল সোনামদের হাতে।
তার পরের ঘটনা ইতিহাস। লাদাখে শিক্ষার কাঠামোর উন্নতি হতে শুরু করে। প্রাপ্ত অর্থ এবং তৎকালীন ভারত সরকারের সহযোগিতায় ভাঙা স্কুলগুলি মেরামত হয়। সোনাম ওয়াংচুকসহ সংস্থার যুবকেরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়া হয়। তৈরি হয় ‘ভিলেজ এডুকেশন কমিটি’। লাদাখের চরমভাবাপন্ন পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ছাপা হয় ‘কনটেক্সচুয়াল’ পাঠ্য পুস্তক। এর ফল ছিল নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী। ৫ শতাংশ থেকে লাদাখের সরকারি স্কুলগুলিতে পাশের হার দাঁড়াল ৭৫ শতাংশ। এইভাবেই সুদূর ডেনমার্কের স্কুলের বাচ্চাদের সাহায্যে লাদাখ শিক্ষায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। আর সেই কর্মকাণ্ডের পরিচালকদের মধ্যে একজন ছিলেন আজকের নায়ক সোনাম ওয়াংচুক।
চিত্রঋণ: Official YouTube Channel Sonam Wangchuk
Discussion about this post