খাবারের দলাটা হাতে নিয়ে মা তার বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন। “খেয়ে নাও নইলে লালকমল নীলকমলের সেই রাক্ষসীরা আসবে।” আর সঙ্গে সঙ্গে অবাধ্য শিশু নিমেষে শেষ করে খাবার। হ্যাঁ, বাঙালি বাড়ির প্রতি বাচ্চাই হয়ত এভাবেই বড় হয়ে ওঠে। ছোট থেকেই তাই, এই ভূত-প্রেত-রাক্ষস-খোক্ষসে তাদের অন্যরকম এক কৌতূহল। আর সেই কৌতূহল থেকেই প্রশ্ন আসে, কালী ঠাকুরের বাম-ডানে ওরা কারা? ওরা ডাকিনী ও যোগিনী। কিন্তু কালীর সাথে কিসের সম্পর্ক এদের? কেনই বা ওই ভয়ঙ্কর রাক্ষসী জোড়ার পুজো হয় কালী পুজোয়?
এর উত্তর পেতে চলুন একটু হিন্দুশাস্ত্র বা পুরাণ, তন্ত্র নথি ঘাঁটি। বলা আছে, দেবী পার্বতীর ভ্রুকুটি কুটিলের লালাটফলক থেকেই কালীর সৃষ্টি। অসুররাজ শুম্ভ ও নিশুম্ভের দুই বলশালী সেনানায়ক চন্ড ও মুন্ডকে বধ করতেই এই রূপের আবির্ভাব।রক্তবীজ দৈত্যের রক্তপান করে তিনি হন ‘চামুন্ডা’। যুদ্ধকালেই কালীর অঙ্গ থেকে জন্ম নেন আটজন মাতৃকা। প্রতিজন থেকে আবার আট করে মোট চৌষট্টিজন মাতৃকার সৃষ্টি হয়। এঁরাই হলেন যোগিনী। ডাকিনী যোগিনী ভিন্ন রূপ হলেও সমার্থক। তাই কালীর অনুচর হিসেবেই যুগলে পুজো পান।
তবে সবটাই কি পৌরাণিক? মানুষের বিশ্বাস মাত্র? গবেষকরা কিন্তু শাস্ত্রের প্রতিটি চরিত্রের ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী যোগসূত্রে বিশ্বাসী। কালী হলেন আদ্যাশক্তি। প্রকৃতির রূপ, নিরাকার অসীম। আর ‘যোগিনী’ হলেন তৎকালীন সেইসব নারী যাঁরা হিন্দু ও বৌদ্ধতন্ত্রের ঐতিহ্যের অংশ। সমাজে সম্মানিত ও জ্ঞানচর্চা পথের অন্বেষক। অন্যদিকে ‘ডাকিনী’ হলেন কৃষ্ণবর্ণের অসুরিনী। জ্ঞানভারে বৃদ্ধা, বিদুষী নারী। এনাদের পরিচয় পুরাণে বর্ণিত। এদেশীয় হওয়ায় তাঁরা ‘রাক্ষসী’ সম্প্রদায়ভুক্ত। বৈদিক যুগের সেই মহীয়সীদেরই, ডাকিনী যোগিনী হিসেবে পুজো করা হয়।
এই মূর্তিগুলো তৈরীর রীতিও বেশ অদ্ভুত। দুর্গা পুজোর ভাসান শেষে প্রতিমা কাঠামো জল থেকে তোলা। তাতেই মাটি লেপা। গেরস্থের ছেঁড়া জামা-কাপড় দিয়ে হয় পোশাক। শনের লুটি দিয়ে চুল। সারা শরীর কুচকুচে কালো। বড় কান, ঠেলে আসা চোখ, টকটকে রাঙা জিভ। পেশাদার শিল্পীরা এই মূর্তি বানাতে খুব একটা হাত লাগান না। আর হাত লাগালে,তার দামও দু’হাজার ছাড়ায়। তাই কাঁচা হাতের শিল্পীরাই এই দুটি মূর্তি বানিয়ে আলাদাভাবে বিক্রি করেন। যদিও এবার ডাকিনী যোগিনী কেনায় কার্পণ্য দেখিয়েছে বহু পুজো কমিটিই। শিল্পীপাড়ায় তাই হাতে গোনা এই যুগল মূর্তি এবারে তৈরী হয়েছে। চলতি মরশুমে, কাটছাঁট চলেছে অনেক কিছুতেই। তাই এই অনুচরী মূর্তিদুটিও আজ বাদের তালিকায়। বাজেট রাখতে শুধু কালী প্রতিমাই জায়গা পেয়েছে মন্ডপে।
চিত্র এবং তথ্য ঋণ – তীর্থ নারায়ণ ভট্টাচার্য্য
Discussion about this post