ইংরেজদের থেকে এদেশের স্বাধীনতা লাভের বয়স নয় নয় করে সাতাত্তরের পথে। তবে আজও বাংলার গৌরবময় বিশেষ কিছু ইতিহাস আমাদের কাছে অজানা রয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনতা পেতে বীর পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরাও যে কত কাঠ – খড় পুড়িয়েছে তা ইতিহাসের পাতায় আজও উজ্জ্বল। ইতিহাস ভোলেনি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কাহিনী, ভোলেনি বাংলার ডাকাত রানি দেবী চৌধুরানীর কথাও। তবে ইংরেজদের রাজ শুরু হওয়ার আগেও ছিল বাংলার গৌরবময় ইতিহাস। জন্মেছেন বীরাঙ্গনা নারীরাও। তবে সবটুকু কি স্থান পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়? নাহ্, একেবারেই নয়। চলুন আজ জেনে নিই তেমনই এক বীরাঙ্গনা নারীর কথা যার ভয়ে কিনা বাঘে গরুতে থুড়ি মোঘল – পাঠানরা এক ঘাটে জল খেয়েছে!
অনেকেরই হয়তো অজানা, পশ্চিম বাংলার হাওড়া ও হুগলি জেলার অন্তর্গত একটি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রাজ্য ছিল ভূরশুট। এই রাজ্যের অধিবাসীরা ছিলেন মূলত বণিক শ্রেণী ও তাদের বলা হত ভুরিশ্রেষ্ঠ। এই রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে যিনি পরিচিত তিনিই হলেন চণ্ডী ভক্ত সেই সাহসিনী নারী রানি ভবশঙ্করী। পিতা ছিলেন রাজ্যের জমিদার দীননাথ চৌধুরী। মাকে হারানোর পর তিনি বাবার সহযোগিতায় অশ্বচালনা, কুস্তি এমনকি তীর চালনাও রপ্ত করেন। পাশাপাশি কূটনীতি, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব ও দর্শনেও দখল ছিল তাঁর। বাবার শিক্ষাতে এভাবেই তিনি বহু দক্ষতার অধিকারী ও একজন সাহসিনী নারী হয়ে উঠেছিলেন।
জানা যায়, দামোদর নদীর তীরে তিনি একদিন একটি হরিণকে বাঁচাতে এক বুনো বাইসনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে এক হাতে হত্যা করেছিলেন। এই ঘটনার সাক্ষী ভুরিশ্রেষ্ঠরাজ রুদ্রনারায়ণ অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন এই নারীকে বিয়ে করেন। এরপর থেকেই তিনি পরিচিত হতে থাকেন রানি ভবশঙ্করী হিসেবে। সেই সময় বাংলাতে তখন ইংরেজদের নয়, চলছে মোঘল ও পাঠানদের ক্ষমতা দখলের লড়াই। ঠিক সেই সময়ই রানি ভবশঙ্করীর রণশক্তির ভয়ে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো অবস্থা হয়েছিল এই দুই প্রতিপক্ষের। কারণ তারা জানত কী ভয়ঙ্কর অসীম ক্ষমতার অধিকারিনী ছিলেন এই রানি!
মন্দির প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামরিক দুর্গ নির্মাণ – রাজ্যের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। একাধিকবার পাঠানদের হারিয়ে তিনি তাদের ভূরশুট রাজ্য ত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। রানির এই বীরত্বের কারণে মোঘল সম্রাট আকবর তাঁকে ‘রায়বাঘিনী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। নাট্যকার দীনেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত তাঁর জীবন কাহিনী নিয়ে রচনা করেছিলেন ঐতিহাসিক নাটক ‘রানি ভবশঙ্করী’। কিন্তু দুর্ভাগ্য! এমন কত রানির কথা অকালেই তলিয়ে গেছে অতল গভীরে। হয়তো এরকমই আরও অনেক নারীর দুর্ধর্ষ কাহিনী স্থান পায়নি ইতিহাসের পাতায়। তবে ইতিহাস ভুলে গেলেও আজও প্রতি বছর তাঁর স্মৃতিতে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে রায়বাঘিনী রানি ভবশঙ্করী মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
Discussion about this post