কবিগুরুর ব্যক্তিত্বে ভ্রমণ পিপাসা ছিল বেশ অনেকটাই। কোনো এক জায়গায় তার মন টিকতো না। বাংলা জুড়ে বিভিন্ন নদীর বুকে ভেসে বেড়িয়েছেন যেমন, তেমনি বাদ যায় নি পাহাড়ী এলাকায় সাহিত্য অভিযান। জমিদারি সামলানোর কাজে এবং নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে অনেক জায়গাতেই যেতে হয়েছে তাকে। ১৯০৭ সালে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের চট্টগ্রাম যান। সেখানকার পাহাড় এবং কর্নফুলী নদীর সম্মিলিত সৌন্দর্যের কথা তিনি আগেই শুনেছিলেন। যামিনীকান্ত সেনের আমন্ত্রণ রক্ষা এবং আরও কিছু কাজের হেতু তার এই দুই দিনের সফর।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে সেদিন শহরের রেল স্টেশনে ভিড় জমান অনেক সাহিত্যপ্রেমী। স্টেশন সেজে উঠেছিল অনন্য রূপে। সাহিত্যানুরাগীদের অভ্যর্থনায় খুশি হন কবিগুরু এবং তার সফরসঙ্গীরা। সেদিন সন্ধ্যেয় চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যাপক ও সাহিত্যিক রজনীরঞ্জন সেনের বাসভবনে বসে এক সাহিত্য আড্ডা। আড্ডা চলাকালীন স্থানীয় কবি-সাহিত্যিকদের সমর্থনে চট্টগ্রামে সাহিত্য পরিষদ স্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এই আড্ডার জন্য তিনি নগরীর আইসিএস জজের নৈশভোজের আমন্ত্রণে অনুপস্থিত থাকেন। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পাঠান ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। আড্ডায় ছিলেন স্থানীয় কবি, লেখক, সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট নাগরিকগণ। তারা হলেন আবদুল করিম, নবীন চন্দ্র সেন, পূর্ণ চন্দ্র চৌধুরী, মৌলানা মনিরুজ্জামান, যাত্রা মোহন সেন, রামচন্দ্র বড়ুয়া, হরিশচন্দ্র দত্ত, আবদুর রহমান দোভাষ, মাহিমচন্দ্র গুহ, কাজেম আলী ও ব্রজ কুমার সেনের মতো চট্টগ্রামের প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ।
পরদিন সাহিত্য পরিষদের সদস্যদের সাথে তিনি বেরোন শহর ভ্রমণে। নদী ভ্রমণে গিয়ে কথা বলেন জাহাজের মাঝি মল্লারদের সাথে। বিকেলে তার সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় কমলবাবুর থিয়েটার হলে (বর্তমান লায়ন সিনেমা হল)। সভার শেষে কবি শ্রোতাদের একটি গানও উপহার দেন। ভ্রমনের আগে থেকেই কবি চট্টগ্রাম নিয়ে বেশ উৎসাহী ছিলেন। সাহিত্যচর্চাই এই উৎসাহের কারণ। নবীনচন্দ্র দাস রচিত কালিদাসের ‘রঘুবংশের’ বাংলা অনুবাদ কবিকে মুগ্ধ করে। শশাঙ্ক মোহন সেন (কবি ভাস্কর) রচিত ‘সিন্ধু সঙ্গীত’ ও কবির ভালো লেগেছিলো। পত্র আদান প্রদানে লেখকদের সাথে গড়ে ওঠে আত্নিক সম্পর্ক। ঠাকুরের আহ্বানে ওকালতি ছেড়ে বিনা বেতনে শান্তিনিকেতনে শিক্ষক পেশায় যোগ দেন যামিনীকান্ত সেন। কলকাতা হাইকোর্ট ছেড়ে আসা এই মানুষটির কাছে কবি ছিলেন কৃতজ্ঞ। তিনি ঠাকুরকে চট্টগ্রাম আসার ব্যাপারে আরও উদ্বুদ্ধ করেন। ঠাকুরদাস মুখার্জির, কবিকে লেখা নানান চিঠিপত্রে চট্টগ্রামের অসাধারণ সৌন্দর্য বর্ণনাও কবিকে আকৃষ্ট করে। এছাড়াও মাস্টারদা সূর্যসেন এবং স্বদেশী আন্দোলনে চট্টগ্রামের মানুষের অবদানও কবির নজর এড়ায়নি।
নোবেলজয়ীর চট্টগ্রাম ভ্রমণের সাথে জড়িয়ে ছিল দুটি ঐতিহাসিক বাড়ি, চট্টগ্রামের প্রথম থিয়েটার হল এবং চট্টগ্রাম পুরাতন রেল স্টেশন। কমলবাবুর থিয়েটার, পাহাড়ের দিকে কমলকান্ত সেনের দ্বিতল বাড়ি এবং নগরীর পার্সিভিল হিলের ‘দি প্যারেড’ নামের বাড়িটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। তবে সেসব বাড়ির কোনো অস্তিত্ব আজ আর নেই। চট্টগ্রাম বটতলী রেল স্টেশনেও নেই কবির সফরের কোনো স্মৃতি স্মারক। বাংলার সাহিত্য ইতিহাস সমৃদ্ধ করতে দ্রুত এসবের রক্ষণাবেক্ষণ দরকার।
Discussion about this post