মানুষের লড়াই এখন সংসার বাঁচানোর। করোনার কোপ আর ঘূর্ণিঝড়ের দাপট এই দুয়ের জেরে মানুষ আজ একরকম অসহায়। দক্ষিণবঙ্গের নদী ও সমুদ্র তীরবর্তী গ্রামবাংলা এখন জলের প্লাবনে বিভৎস রূপ নিয়েছে। হারিয়েছে কত খেটে খাওয়া মানুষের সংসার। মানুষ যেন আজ প্রত্যক্ষ করছে ইতিহাসের কোনো এক বিশেষ অধ্যায়কে। আর সেই বিশেষ অধ্যায়টি হল ‘১৭৩৭ বেঙ্গল সাইক্লোন’। সেদিনও ঠিক একইভাবে বাংলা সম্মুখীন হয়েছিল ভয়ঙ্কর এক প্রলয়ের। তখন না ছিল আগাম কোনো সতর্কবার্তার প্রচার আর না ছিল মানুষের তেমন সচেতনতার পরিমাপ।
বেশি মুনাফার লোভ ও ব্যবসার সুবিধার জন্য ব্রিটিশ তখন ঘাঁটি গেঁড়েছে নতুন কলকাতা অর্থাৎ কলকাতা গোবিন্দপুর আর সুতানটির সমগ্র এলাকাতে। আর ওই ঘাঁটি তদারকির দায়িত্বে তখন জন স্ট্যাকহাউস। সালটা ১৭৩৭। ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যের দিকে হঠাৎই কলকাতার আকাশ ছেয়ে যায় ঘন কালো মেঘে। এক ভয়াবহ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয় গোটা নগরী জুড়ে। কিন্তু প্রমত্ত দানবের মতো প্রলয় এল সেই মাঝ রাতে। তীব্র গতিবেগে সাগর থেকে কলকাতায় ধেয়ে এল সেই ঝড়ের ঝাপটা। ওদিকে হুগলী নদীর ভূমিকম্পে জলোচ্ছ্বাসের তান্ডব। এক একটা ঢেউয়ের উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুটের কাছাকাছি। আর তার দোসর ৬ ঘন্টা ধরে একনাগাড়ে চলা মুষলধারায় বৃষ্টি। ব্রিটিশ আদি উপাসনালয় অ্যানের গীর্জাটি শেষ হয় জলের তোড়ে। ২০ হাজার নৌকা উল্টে পড়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়। কুমোরটুলি মন্দিরের পঞ্চরত্ন চূড়াটিও ভেঙে পড়ে নিমেষে। বানের প্রবল ধাক্কায় ধুলিস্মাৎ হয় গঙ্গার ঘাট। কোনো সতর্কতা সূচী না থাকায় তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ বলি হয় এই প্রলয়ে। সুন্দরবনের পশুপাখিদেরও প্রাণ টানে এই প্লাবন। কুমিরের দল ডাঙায় এসে মানুষের সঙ্গেই আশ্রয় নেয়। মাঝিসহ হারিয়ে যায় ৮ টি নৌকা।
বাংলার ইতিহাসে আজও তাই ১৭৩৭ এক বিনাশকারী সাল হিসেবই পরিচিত। ভূমিকম্পের সাথে ঘূর্ণিঝড়ের যুগলবন্দিতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় দক্ষিণবঙ্গের বহু সংসারের যাপন। ‘জেন্টলসম্যান’, ‘লন্ডন ম্যাগাজিন’, ‘মৌসম’ পত্রিকাগুলোতে এই দুর্যোগের বিস্তৃত প্রমাণও মেলে। কালের নিয়মে দুঃসময় আসে, আবার চলেও যায়। দুর্যোগের ব্যপকতায় পুরনো কলকাতা ধ্বংস হলেও হারায়নি তার গৌরব। মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে সেদিনও। ঠিক ওভাবেই আজও মানুষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফের মেরুদন্ডকে শক্ত করার। আবারও সাধের বাংলাকে দৃষ্টিনন্দিত করে সাজিয়ে তুলতে।
Discussion about this post