প্রকৃতির হাত ধরেই আমাদের প্রথম পথচলা শুরু। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিটা দরকারি জিনিসকে যেন অদ্ভুত কৌশলে সাজিয়ে আমাদের সামনে পরিবেশন করে এই প্রকৃতি। আর প্রকৃতির শৌখিন থালায় সুগন্ধিতম পদটি হল আগর কাঠ। যাকে বিশেষ সম্মানের সাথে ‘The woods of the Gods’ বা ‘ঈশ্বরের কাঠ’ বলা হয়ে থাকে। যার মন মাতানো গন্ধের ভারে প্রকাশ পায় আভিজাত্য। আজ তবে চলুন আতর মাখা সেই গাছটির ব্যাপারে কিছু জেনে নেওয়া যাক।
মুঘল আমলে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটে আগর শিল্পের সুনাম বিশ্বজুড়ে। বর্তমানে সিলেটের মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা সুজানগর সুগন্ধি আগর কাঠের বনাঞ্চলের জন্য বিখ্যাত। একটি পূর্ণাঙ্গ আগর গাছ হতে হলে ২০ থেকে ২২ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। পরিপূর্ণ একটি আগর গাছ দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি হয়। আগর গাছের কাঠ থেকে বিশ্বখ্যাত মহা-মূল্যবান আগর ও সুগন্ধি তৈরি হয়। দুইভাবে আগর গাছের কাণ্ড বা মোটা ডাল থেকে আগর উৎপাদন করা হয়- প্রাকৃতিক পদ্ধতি ও কৃত্রিম বা পেরেক পদ্ধতিতে। আগর গাছের বয়স পাঁচ থেকে দশ বছর হলেই তার কাণ্ড কালো বর্ণ ধারণ করে। এসময় গাছের বিভিন্ন স্থানে কালো ছোপ পড়ে গাছের এই কালো অংশকেই বলা হয় সুগন্ধি আগর।
এবার বিশ্বের ব্যয়বহুল সুগন্ধি তরল আগরের প্রস্তুত প্রণালী সম্বন্ধে জানা যাক। আগর বাগান থেকে পূর্ণ বয়স্ক গাছ কেটে এনে প্রথমে তা টুকরো করে কেটে আলাদা করা হয়। এ টুকরোগুলোর দুইভাগ করা হয়। এক ভাগ ঘন কালো, হালকা কালো, তামাটে, অল্প তামাটে বর্ণের কাঠের টুকরা। অন্য ভাগে ধূসর, প্রায় সাদা বর্ণের কাঠের টুকরা থাকে। হালকা কালো, তামাটে ও অল্প তামাটে রঙের আগর কাঠের লগগুলোকে লম্বালম্বিভাবে কাটা হয়। অত্যন্ত যত্ন ও সুনিপুণভাবে ফালি করা হয় যেন কালো অংশ বা আগরগুলো আস্ত থাকে। চেরা ফালিগুলো স্থানীয় ভাষায় ‘ধুম’ বলে। কারখানাগুলোতে ধুম তৈরির কাজগুলো মূলতঃ নারীরা করেন।
ধুম করার পর কাঠের ফালিগুলোকে কুচি কুচি করে কাটা হয়। চেরা ফালিগুলো কুচি কুচি করতে দাঁ ব্যবহারের পাশাপাশি বহু কারখানায় মেশিন ব্যবহার করা হয়। এরপর কুচি করে কাটা টুকরোগুলো একটি পাত্রে বা জলের ট্যাঙ্ক, ড্রাম, বড় হাঁড়িতে ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত ভেজানো থাকে। এরপর কাঠগুলো তুলে জল ঝরিয়ে ঢেঁকি দিয়ে গুঁড়ো করা হয়। স্থানীয় ভাষায় কাঠের গুঁড়া অংশগুলোকে ‘ছুরন’ বলা হয়। পরবর্তীতে, ছুরনগুলোকেও কমপক্ষে আট থেকে দশ দিন ভিজিয়ে রাখতে হয়। খুব ভালোভাবে পচে গেলে সেগুলো তুলে নেয়া হয়। এরপর একটি জল ভর্তি স্টিলের পাত্রের মধ্যে রেখে নিচ থেকে আগুনের তাপ দিতে হয়। পাত্রের চারিদিক খুব ভালোভাবে বন্ধ করা থাকে, অনেকটা এয়ার টাইটের মতো। এভাবে টানা ১০ থেকে ১২ দিন তাপ প্রয়োগ করতে হয়। পাত্রের ওপরের দিকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় একটা নল যুক্ত করা হয়। নলটির অন্য প্রান্ত আরেকটি পাত্রের সঙ্গে জোড়া থাকে।
আগুনের তাপে ছুরন কাঠ সেদ্ধ হয়ে বাষ্পাকারে ওপরের নলে প্রবেশ করে। সেই বাষ্পগুলোই ঘনীভূত হয়ে অপর প্রান্তের পাত্রের মধ্যে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকে। সেই জমতে থাকা জলের উপরেই তৈলাক্ত আস্তরণ পড়ে। এই আস্তরণই থেকেই তৈরি হয় বিশ্বের মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সুগন্ধি। এরপর এই তরল আস্তরণ পৃথিবীর বিখ্যাত নামি-দামি সুগন্ধি প্রস্তুতকারী কারখানায় রপ্তানি হয়। চটকদারি কৃত্রিমতার যুগে প্রাকৃতিক জিনিসের কদর কমলেও, প্রকৃতির ওপর নির্ভরতআপাল্লাটা আজও একইভাবে অটুট।
সম্পাদনা – অনন্যা করণ
Discussion about this post