“মশায়! দেশান্তরি করলে আমায় কেশনগরের মশায়; কেশনগরের মশার সাথে তুলনা কার চালাই?”– অন্নদাশঙ্কর রায়-এর এই হাস্যকৌতুক ছড়াটি আমাদের অনেকেরই পরিচিত। এই কেশনগরের সঙ্গে মশার ব্যাপারে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে এমন এক জায়গা ছিল বাংলাদেশের রাজধানী। আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই, জন্মলগ্ন থেকেই ঐতিহাসিকভাবে ঢাকা মশার জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু সেই মশার বংশ বিস্তারে বাধ সেধেছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি সারাজীবনই ‘কথা কম কাজ বেশি’ মন্ত্রণায় আস্থা রেখেছিলেন। তিনি হলেন দেশভাগের পর নিয়োজিত পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা ফেনীর সন্তান হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। তাঁর আরেক পরিচয় হল তিনি ছিলেন কলকাতা মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাবেক অধিনায়ক।
ঢাকায় তাঁর মশা নিধন অভিযান সম্পর্কে জানার আগে জেনে নেওয়া যাক রাজধানীতে মশার উপদ্রবের নমুনা ঠিক কেমন ছিল। ভারতে আসা মুঘলদের রাজত্বকালে তাদের বাণিজ্যিক রাজধানী ছিল এই ঢাকা। কিন্তু মুশকিল হল “কেশনগরের মশায়” থুড়ি ঢাকার বিখ্যাত মশায়। ইতিহাস বলছে– এই ছ’ পেয়ে-র অত্যাচারে তারা অতিষ্ঠ হয়ে গিয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এবার মুঘলদের পর ইংরেজ শাসনামলে যত অসাধু সৈনিকরা ছিল তাদের জন্য এক অভিনব শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন ক্যাপ্টেনরা। ইংরেজ শাসনামলে ঢাকায় তাদের যে ক্যান্টনমেন্ট ছিল সেটি মূলত ব্যবহৃত হতো সৈনিকদের ‘পানিশমেন্ট পোস্টিং’ হিসেবে। তাই তাদের সেসময় পাঠিয়ে দেওয়া হত ঢাকায়। যাতে মশার কামড় খেয়ে ম্যালেরিয়া বাঁধিয়ে এক্কেবারে সোজা হয়ে যায়।
এরপর দেশভাগ হল। ঢাকা হল পূর্ববঙ্গের রাজধানী। ভারত থেকে লাখে লাখে মুসলমান বা নতুন লোকজন থাকতে শুরু করল ঢাকায়। কিন্তু মশার যন্ত্রণা কিছুতেই আর ঘোচে না! শেষমেষ হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী উদ্যোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০,০০০ সংখ্যক মশার ওষুধ ছড়ানোর মেশিন আনালেন। এমনকি রাস্তার পাশে গভীর ড্রেন খনন করিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থা আধুনিক করার প্রক্রিয়া তিনিই প্রথম চালু করেন। শহরের সব নোংরা পুকুর-খাল-ডোবা পরিষ্কার করানোর নির্দেশ দিলেন। এখানেই শেষ নয়, ইস্পাহানির সাহায্যে মশার ওষুধ ছড়ানোর জন্য দুটো বিমান পর্যন্ত কিনেছিলেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে মাত্র দু-বছরের মধ্যে তিনি ঢাকার বুকে মশার প্রকোপ একেবারে নির্মূল করে ফেলেছিলেন। তাঁর মশা নিধন অভিযান এতটাই সফল হয়েছিল যে এর দশ বছর পরেও মানুষ মশারি না টাঙিয়েও ঘুমোতে পারত!
Discussion about this post