পশ্চিমঙ্গে ইতিমধ্যেই আছড়ে পড়েছে আমপান। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পরিমান আশঙ্কা করেছেন সকলেই। আমপান ইতিমধ্যেই সুপার সাইক্লোনের তকমা পেয়েছে। একটা বিষয় আমাদের সকলেরই চোখে পড়বে যে, যতদিন যাচ্ছে সাইক্লোনের সংখ্যাও ততই বাড়ছে। আয়লা হতে না হতেই ফনি, ফনি যেতে না যেতেই বুলবুল, তারপর এখন আমপান… যেন একটার পর একটা লেগেই রয়েছে। এর কারন কি শুধুই প্রাকৃতিক না অন্য কিছু, তা জানা-বোঝার প্রয়োজন রয়েছে।
আগে যে সাইক্লোন হত না তা নয়, কিন্তু এত কম সময়ের ব্যবধানে এত বেশি সাইক্লোন এর আগে হত না। শুধু বঙ্গোপসাগর নয়, আরবসাগর দেখলেও একই অবস্থা। ২০১৪ তে নিলোফার, ২০১৫ সালে মেঘ, সাইক্লোনের সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে। শুধু সংখ্যাই নয়, বাড়ছে সাইক্লোনগুলোর তীব্রতাও। নিলোফার, মেঘ, ফণি সবই এক্সট্রিমলি সিভিয়ার ট্রপিকাল সাইক্লোনের পর্যায়ে পড়ে। এদের হাওয়ার গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটারের বেশি। গবেষণা জানাচ্ছে গত এক শতকে প্রতি পাঁচ বছর, আর আগের পাঁচ বছরের তুলনায় তিনটি করে বেশি সাইক্লোন হচ্ছে। শুধুমাত্র ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল, এই দশ বছরে আগের ১০ বছরের তুলনায় ৬ টি সাইক্লোন বেশি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা জানাচ্ছেন গ্লোবাল ওয়ার্মিং। গ্লোবাল ওয়ার্মিং যত বাড়ছে, ততই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। ফলে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠে জলের তাপমাত্রাও। এই তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রির বেশি হলে সাইক্লোনের জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলের তাপমাত্রা আগের থেকে অনেক বেশি সময় ধরে ২৮ ডিগ্রির বেশি থাকছে। শুধু ভারত মহাসাগরেই নয়, প্রশান্ত মহাসাগর কিংবা আটলান্টিক বিশ্বজুড়ে সব জায়গাতেই একই অবস্থা। বিগত কয়েক দশকে সাইক্লোন এর সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে তীব্রতাও।
সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ থাকলে, এই সাইক্লোনগুলির প্রথম ধাক্কা সামলায় ম্যানগ্রোভ। তার ফলে জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে ঢোকার আগেই সাইক্লোনের তীব্রতা অনেকটা কমে যায়। একটি গবেষণা জানাচ্ছে, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী ম্যানগ্রোভ অরণ্য বুলবুলের গতিকে ঘণ্টায় প্রায় কুড়ি কিলোমিটার কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ম্যানগ্রোভের এই প্রাকৃতিক দেওয়াল প্রতিবছর কমছে। দীঘার সমুদ্রের পাড়ে বিশাল ঝাউবনগুলো শুধু আপনার রোম্যান্স করার জন্য তৈরি হয়নি। প্রকৃতি সেই ঝাউবন তৈরি করেছে ঝড় থেকে আপনাকে বাঁচাবার জন্য। সেই আমি-আপনিই দীঘার ঝাউবনকে প্রতিদিন ধ্বংস করে রিসর্ট বানাই। ১৯৮৮-২০১৮ এই দুই দশকে সুন্দরবন অঞ্চলের ম্যানগ্রোভের পরিমাণ চার ভাগের এক ভাগ কমে গিয়েছে। এর কারণ সরকারের ভ্রান্ত পরিবেশ নীতি ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং। ভারতবর্ষের ৭৫০০ কিলোমিটার উপকূল যা নানান জীববৈচিত্র্যে ভরপুর, তাকে বাঁচানোর বদলে তাকে নষ্ট করার জন্য আইন আনতে চলেছে সরকার।
১৯৯১ সালে প্রথম কোস্টাল রেগুলেশন নোটিফিকেশন আনা হয়, যেখানে হাই টাইডলাইন থেকে ৫০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে কোস্টাল রেগুলেশনের আওতায় আনা হয় (সিআরজেড), যার ১০০ মিটার ছিল ‘নো ডেভেলাপমেন্ট জোন’ অর্থাৎ ওই অঞ্চলে কোনো ধরনের প্রকল্পই করা যাবে না। কিন্তু ১৯৯৪ সালে এটিকে সংশোধন করে নো ডেভেলাপমেন্ট জোন যা হাই টাইড লাইন থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত ছিল, তাকে কমিয়ে ৫০ মিটার পর্যন্ত করা হয়। তার বাইরের এলাকা কনস্ট্রাকশনের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ২০০১ এ আবার এটিকে সংশোধন করা হয় এবং অ্যাটমিক এনার্জি প্রোজেক্টের জন্য পাইপ লাইন পাতার অনুমতি দেওয়া হয়। ২০০২ থেকে ২০১৫ এর মধ্যে এই নোটিফিকেশন বারবার সংশোধন করে হোটেল, রিসোর্ট করার পারমিশন দেওয়া হয়, এমনকি ইকো সেনসিটিভ এরিয়াতেও। ২০১৮ তে আবার ৬০৬৮ কিলোমিটার কোস্ট লাইন খুলে দেওয়া হয় ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের জন্য। কাজেই বুঝতেই পারছেন উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলি হোটেল, রিসর্ট, ব্যবসার কাজে ব্যবহার করার ঢালাও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যার ফলে উপকূলবর্তী অঞ্চল ধরে বারবার ম্যানগ্রোভ কাটা হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে প্রকৃতির নিজস্ব সুরক্ষা-বর্ম।
তাছাড়া গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফলে সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বাড়ায় বেশি পরিমাণ লবণাক্ত জল ঢুকে যাচ্ছে সুন্দরবন অঞ্চলে। যার প্রভাবে ওই অঞ্চলের মাটি বেশি লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে আর অতিরিক্ত লবণের কারণে প্রায় ৫-১০% ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রতিবছর মারা যাচ্ছে। ম্যানগ্রোভের কমে যাওয়া আসলে সাইক্লোনের স্থলভাগে ক্ষয়ক্ষতি করার ক্ষমতাকেই বাড়িয়ে দেয়। আপাতভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আকারে এই সাইক্লোন হাজির হলেও, মানুষের তৈরি দূষণ ও সরকারের ভ্রান্ত পরিবেশ নীতিরই ফলাফল সাইক্লোন বেড়ে যাওয়া ও তার ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলায় এই যে সর্তকতা, তা যদি আমরা সারা জীবনের জন্য নিই তো খুব ভালো হয়। স্বপ্ন দেখি, পরের বছরও আমফান আসবে অন্য নামে। আমাদের বাঁচানোর দায়টা তার ওপরেই ছেড়ে দেব আমরা। আমার বিশ্বাস আমফানরাই আমাদের বাঁচাবে, ঠিক আমাদের দাদু ঠাকুমাকে যেমন করে বাঁচাত, যদি আমরা প্রকৃতিকে বাঁচাই তাহলে। আর রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন? এরাই তো আসল নাটের গুরু, ওদের দয়ার দান লাগবে না।
প্রতিবেদক – গৌরব পদবী-হীন
Discussion about this post