ব্রিটিশ আমলের কলকাতার ইতিহাসে শাসক-শোষিতের সংঘাত যেমন ছিল, তেমনই লুকিয়ে ছিল কিছু মানবিকতার অধ্যায়ও—যার অন্যতম নায়ক কোলস্ওয়ার্দি গ্র্যান্ট। চার্লস ডি’য়লির মতো তিনিও ছিলেন উচ্চমানের চিত্রশিল্পী, অথচ তাঁর পরিচয় শুধুই শিল্পকলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৮১৩ সালে লন্ডনে জন্ম নিয়ে পরে কলকাতায় পা রাখা গ্র্যান্টের মন ছিল গভীরভাবে সংবেদনশীল; নিজের প্রিয় পার্সিয়ান বিড়ালের মৃত্যুই তাঁকে প্রথম ধাক্কা দেয়, আর প্রতিদিন রাস্তায় রোগা, ক্ষতবিক্ষত ঘোড়া-গরুর ওপর অত্যাচার দেখে তাঁর মধ্যে জন্ম নেয় প্রতিবাদের সংকল্প।
সেই সংকল্প থেকেই ১৮৬১ সালের ৪ অক্টোবর আর্চডিকন প্র্যাটের সভাপতিত্বে একটি ঐতিহাসিক জনসভা আহ্বান করেন গ্র্যান্ট, যেখানে উপস্থিত ছিলেন আলেকজান্ডার ডাফ, ডঃ মৌট, প্যারীচাঁদ মিত্র, মৌলভী আব্দুল লতিফ, প্রতাপ চন্দ্র সিংহ ও শেঠ আপকারের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। সেখানেই জন্ম নেয় এশিয়ার প্রথম প্রাণী-কল্যাণ প্রতিষ্ঠান—‘ক্যালকাটা সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেলস’ (CSPCA)। ভাইসরয় লর্ড এলগিন এই উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষক হন এবং গ্র্যান্ট হন অবৈতনিক সম্পাদক। প্যারীচাঁদ মিত্র লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ‘অ্যাক্ট ১’ ও ‘অ্যাক্ট ৩’ পাশ করিয়ে পশু-নির্যাতন রোধে আইনি ভিত্তি তৈরি করেন, যদিও স্টুয়ার্ট হগসহ কিছু ইউরোপীয় প্রশাসকের বিরোধিতা ছিল প্রবল।
শুরুর দিকে গ্র্যান্টের নিজের হেয়ার স্ট্রিটের বাড়িতেই সোসাইটির সব কাজ চলত। তবে তাঁর মৃত্যুর পর এই সোসাইটির কার্যস্থল স্থানান্তরিত হয় বউবাজার স্ট্রিটে—যেখানে আজও প্রতিষ্ঠানটি সক্রিয়। ১৯৫৪ সালে এই সোসাইটি আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত হয়। শিল্পী হিসেবেও গ্র্যান্ট হয়ে রয়েছেন অমর; তাঁর ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ডমেস্টিক লাইফ’ (১৮৬২) ও ‘রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল’ (১৮৬৪) আজও বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মূল্যবান দলিল।
১৮৮০ সালের ৩১ মে গ্র্যান্টের মৃত্যু হলেও প্রাণীকল্যাণে তাঁর অবদান কলকাতা থেকে মুছে যায়নি। ডালহৌসি স্কোয়ারের উত্তর-পূর্ব কোণে তাঁর স্মৃতিতে নির্মিত ‘অবেলিট’ আজও সাক্ষ্য দেয় এক ইংরেজ শিল্পীর মানবিকতার। আজকের ব্যস্ত মহানগরে গ্র্যান্টের নাম হয়তো বিস্মৃত, কিন্তু অবলা জীবের প্রতি করুণা, যত্ন ও অধিকার রক্ষার যে মশাল তিনি জ্বালিয়েছিলেন, তা এখনও অম্লান।







































Discussion about this post