সুবিশাল ভারত। বছরের বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রতিটি কোণায় নানা ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি পালিত হয়। প্রাচীন বিভিন্ন আচারের মধ্যে লুকিয়ে আছে মানব সভ্যতার গৌরবময় অতীত। তবে কিছু প্রথার সাথে মিশে অন্ধকার কুসংস্কার। প্রথাগত কিছু ধার্মিক আচার যে কতটা ভয়ঙ্কর ও নৃশংস হতে পারে তারই নিদর্শন দক্ষিণ ভারতের কেরালার ‘চুরাল মুরিয়াল’। প্রায় ২৫০ বছরেরও পুরনো এই প্রথা।
প্রতি বছর মার্চে কেরালার চেট্টিকুলাঙ্গারা মন্দিরে আয়োজিত হয় ‘কুম্ভ ভারানি’ উৎসব। যা দক্ষিণের কুম্ভ মেলা নামে খ্যাত। সেই উৎসবেরই একটি অংশ হল ‘চুরাল মুরিয়াল’। নিজেদের কল্যাণ এবং দেবীদের তুষ্ট করার নামে শারীরিক নিপীড়ন করা হয় দশ বছর বা তার কমবয়সী শিশুদের উপর। প্রথমে শিশুদের নতুন রং-বেরঙের পোশাক পড়িয়ে, কপালে তিলক কেটে পুজো করা হয়। যা দেখলে মনে হয় সামান্য পুজো, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে সবচেয়ে কু-প্রথাটি। বাস্তবে এই পুজোর মাধ্যমে শিশুটিকে প্রস্তুত করা হয় দেবী ভদ্রকালী কাছে উৎসর্গের জন্য।
পুজোর পর ছোট্ট শিশুদের পাঁজরে গেঁথে দেওয়া হয় একাধিক সূচ। সেই সূচে পরানো থাকে সোনার সুতো। এরপর এই রক্তাক্ত অবস্থাতেই হাঁটিয়ে চেট্টিকুলাঙ্গারা মন্দিরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় ছোট্ট শিশুদের। বাচ্চাদের আর্তনাদ, চিৎকারে কেঁপে ওঠে সমগ্র মন্দির চত্বর। মন্দিরে পৌঁছোনোর পর, দেহ থেকে ওই সূচ-সুতো বের করে নেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন বাচ্চাদের রক্তেই সন্তুষ্ট হন দেবী ভদ্রকালী। তবে মানুষের ভক্তির কারণে এই নৃশংসতা পরিণত হয়েছে ‘ভক্তিমূলক’ অনুষ্ঠানে। যা দেখতে ভিড় জমান পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অজস্র মানুষ।
এই রীতির সবচেয়ে কলুষিত দিকটি হল, এর সাথে জড়িয়ে টাকার এক অদ্ভুত খেলা। এই পুজো সাধারণত করে থাকেন অঞ্চলের ধনী পরিবারেরা। মানা হয়, এতে তাদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তাঁরা নিজেদের পরিবারের কোনও শিশুকে এই উৎসর্গ অনুষ্ঠানে পাঠায় না। মূলতঃ গরিব পরিবার থেকে তাদের ঘরের ছেলেকে ভাড়া নেওয়া হয় এই ‘উৎসর্গে’র জন্য। বদলে শিশুটির পরিবার পায় কয়েক লক্ষ টাকা। অর্থ লাভের পাশাপাশি পুণ্যের আশায় শিশুটির পরিবারও কোন বাধা দেন না।
২০১৬ সালে এই প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ‘কেরালা স্টেট কমিশন ফর প্রোটেকশন অব চাইল্ড রাইটস’। কিন্তু তাতেও বন্ধ হয়নি এই অমানবিক কর্মকান্ড। ভারতীয় সংবিধানে দেশের সর্বত্র ভারতীয় নাগরিকদের স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচারের অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই অধিকারের নামে নৃশংসতা সমর্থনযোগ্য নয়। শুধু মাত্র নাগরিক সচেতনতাই পারে এই প্রথা বন্ধ করতে। আশা করাই যায়, সেই সুদিন খুব তাড়াতাড়িই আসবে। বাঁচবে বহু শিশুর জীবন।
Discussion about this post