সুন্দরবনের জলকাদা, নদীর ঢেউ আর ছায়াঘন জঙ্গলের ভেতর বড় হয়ে ওঠা শিশুদের কাছে একটি নাম আজও গভীর আবেগ জাগায়—‘ছৈলার মধু’। দোকান থেকে কেনা মধুর মতো নয়; এই মধু ছিল শৈশবের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি, যা আজ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। ছৈলা গাছ সুন্দরবনের নদী মোহনার কাছাকাছি কিংবা সুন্দরবনের জঙ্গলের মাঝে বেড়ে ওঠা একটি মাঝারি থেকে উঁচু গাছ। এই গাছের টক স্বাদের ফল দিয়ে স্থানীয়রা ডাল, আচার কিংবা ভর্তা তৈরি করেন। কিন্তু এর ফুলের কুঁড়িই সৃষ্টি করে সেই অনন্য সাদা, স্বচ্ছ, একফোঁটা ছৈলার মধু, যা সুন্দরবনের মানুষদের স্মৃতিমেদুর করে দেয়।
তবে ছোট বাচ্চাদের জন্য ছৈলার মধু সংগ্রহ কোনো সহজ কাজ নয়। এই গাছ কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ লম্বা হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় কুঁড়ি সংগ্রহ করতে গাছের উপরেও উঠতে হয়। কিন্তু তবুও, এই আনন্দটাই ছৈলার মধু সংগ্রহকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। বিকেলের দিকে গিয়ে ছৈলার গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয় ছৈলা ফুলের কুঁড়ি। অন্যদিকে, নদীর পাড়ের নরম কাদামাটি নিয়ে এসে একটা বড় থালায় চেপে চেপে বসিয়ে তৈরি করা হয় বেস। এরপর ফুলের কুঁড়িগুলোর নিচের অংশটা ছুরি দিয়ে কেটে, মাথার দিকটা ফাটিয়ে দিয়ে, ফুলের বৃতির অংশটা সামান্য খুলে দিয়ে ফুলগুলোকে থালার উপরে বসিয়ে দেওয়া হয়। আর এরপর এই পুরো ব্যবস্থাটা ঢেকে দেওয়া হয় আরেকটা থালা দিয়ে আর মাঝের ফাঁকগুলো নরম মাটি দিয়ে এমনভাবে আটকে দেওয়া হয় যাতে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে। আর থালাটি রেখে দেওয়া হয় সারা রাত, যাতে রাত্রিবেলার ভ্যাপসা আবহাওয়ায় ফুলগুলো ফুটতে পারে।
এরপর ভোরবেলা স্কুলে যাওয়ার আগে বাচ্চাদের প্রথম কাজ উপরে থালাটাকে সরিয়ে দেখা কতগুলো ফুল ঠিকঠাকভাবে ফুটেছে। থালা সরানোর সঙ্গে সঙ্গেই দেখা মেলে লাল সাদা রঙের সেই প্রস্ফুটিত ছৈলা ফুলের, যার মধ্যেই রয়েছে এই আকাঙ্খিত মধু, যার জন্য এত কিছু করা। ফুলের পাপড়িগুলো আলতো করে সরিয়ে দিলে ফুলের ভিতরের অংশ থেকে পাওয়া যায় কয়েক ফোটা স্বচ্ছ, চকচকে আর অদ্ভুত ভাবে মিষ্টি ছৈলার মধু। মৌচাকের মধুর মতো ঘন নয়, কিন্তু স্বাদে এমনই খাঁটি, যেন প্রকৃতি নিজ হাতে বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এই এক ফোঁটা মধুই ছিল এই বাচ্চাগুলোর শৈশবের সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কার।
আজকাল আর এই দৃশ্য বিশেষ দেখা যায় না। ছৈলা গাছ আগের মতো ঘন ঘন চোখে পড়ে না। বাচ্চারা আর কাদা পুঁতে থালা সাজায় না। সময়, প্রযুক্তি আর বদলে যাওয়া জীবনযাত্রার ভিড়ে ছৈলার মধু ক্রমেই চলে গেছে স্মৃতির গভীরে। শুধু রয়ে গেছে সেই গল্পগুলো—কাদায় হাত ডুবিয়ে থালা বানানো, কুঁড়ি ফোটার অপেক্ষায় রাতে বারবার দরজার ফাঁক দিয়ে তাকানো, আর একফোঁটা মধুর স্বাদে আনন্দে ভরে ওঠা মুখগুলো।






































Discussion about this post