কোনো বিষয়ে দক্ষতার পরিচয় দিতে গেলে সমাজের নজরে আসে শুধুই অ্যাকাডেমিক ডিগ্রী। যে যত ডিগ্রীধারী সে তত দক্ষ, আদ্যিকালের এমনই ধারণা আজও পুষে চলেন অনেকেই। কিন্তু প্রতিভা কি সত্যিই কোনও প্রথাগত শিক্ষাকে ঘিরে তৈরী হয়? নিজের ভালোবাসার কাজটিকে যে লাগাতার অভ্যেসের সুতোয় বেঁধে ফেলছে। নিঁখুত হওয়ার অপেক্ষায় সে স্বপ্নেও যাপন করে তার সেই ভালোলাগাকে। তার কাছে তো শিল্পটাই একসময় হয়ে ওঠে আবেগ। আর সেই আবেগের স্বীকৃতি পেতে যখন প্রশ্ন আসে শিক্ষাগত যোগ্যতার তখন ব্যাপারটা আঁতে ঘা লাগে বৈকি। তাই চিরাচরিত ওই প্রথাকে ভাঙতেই আজ রাস্তায় সেজে উঠেছে একগুচ্ছ রংতুলি। ‘ছবিওয়ালা’র হাত ধরে আজ ফুটপাতেই আসন পেতেছে আস্ত এক আর্ট গ্যালারি।
২০১৯ এর ২৮ জুন। দক্ষিণ কলকাতার সৌরভ মিত্র ও বিপ্লব ধরের হাত ধরে শুরু হয় স্বশিক্ষিত চিত্রশিল্পীদের প্রথম হামাগুড়ি দেওয়া। সেটিই ছিল ‘ছবিওয়ালা’র ১৭ জন শখের আঁকিয়েদের প্রথম প্রদর্শনী। কিন্তু সেদিন তাঁরা হয়ত এটা জানতেন না ওই হামা টানা চেষ্টাটা একদিন পাল্লা দেবে ঝাঁ চকচকে সমকালীন প্রদর্শনীগুলির সাথে। ভুরিভুরি প্রশংসা আর ভালোবাসার হাতছানিতে ‘ছবিওয়ালা’ আর পেছনে ফেরেনি কোনোদিন। রং পেন্সিল, তেলরঙ, জলরঙ, অ্যাক্রেলিক কিংবা বিমূর্ত ভাবের একঝাঁক চিত্র ঝুলল ক্লিপে আঁটা রেলিং জুড়ে। মোহরকুঞ্জের বাইরের ওই ফুটপাথটি তখন পরিণত হল নান্দনিক এক আর্ট গ্যালারিতে। যেখানে আমার আপনার মতো সাদামাটা পথচলতিরাই স্থান পেল স্ট্যান্ডার্ড এক আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সিউড়ি, আসানসোল, নদীয়া, বর্ধমানও সাজলো ‘ছবিওয়ালা’র ছবি ভান্ডারে। এখানেই কিন্তু শেষ নয়। লকডাউন পরিসরে শুরু হল লাগাতার অনলাইন এক্সিবিশনের পর্ব ‘কোয়ারেন্টাইন ক্রিয়েটিভিটি’। দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষের সাড়া মিলল। একপা দু’পা করে এগোতে এগোতে গত ২৯ জুন শুরু হল ‘ছবিওয়ালা’র সপ্তম প্রদর্শনী। এবার আর শুধুই ভারত নয়। বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড, সৌদি আরব, জার্মানীর বিদেশী শিল্পীদের থেকেও এসেছে অংশগ্রহণের আর্জি। প্রথাগত শিক্ষার অভাবে সেদিনের সেই তাচ্ছিল্যকে আঁকড়েই ছবিওয়ালা আজ পৌঁছেছে আন্তর্জাতিক মাত্রায়।
শিল্পী তৌসিফ হক, চিন্ময় মুখোপাধ্যায়, সৌরভ মিত্র, অমিত মন্ডল, শুভ্রজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, ত্রিগুণ জয়, গৌতম দাস, রৌদ্র মিত্র প্রমুখদের আদর যত্নের লালনে ‘ছবিওয়ালা’ আজ শীর্ষ শিখরে। কর্ণধার সৌরভ মিত্র জানান “ছবিওয়ালা আমাদের স্বপ্নের দল। তাই এই স্বপ্নের জন্মদিনে ‘স্বপ্ন’কেই বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছি আমরা। অতিমারীর যে দুঃসময়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি প্রত্যেকে, এই স্বপ্নটুকুই তো পারে আমাদের সকলকে এক করে বেঁধে রাখতে!” পরিস্থিতির বিকল্প হিসেবে ভার্চুয়াল এক্সিবিশন হলেও ‘ছবিওয়ালা’ আজও শহরের সুস্থতার অপেক্ষায় রয়েছে। যেদিন আবার রাস্তায় মানুষের সেই ভিড় চোখে পড়বে সেদিন আবারও ‘ছবিওয়ালা’ তার ছবির প্রকান্ড পুঁটলি নিয়ে নামবে ফুটপাত গ্যালারিতে। আবারও স্বশিক্ষিত শিল্পীদের কল্পনার রঙে ভাসবে পথচলতি মানুষ।
Discussion about this post