প্রকৃতির নিয়মে বাংলার ঋতুচক্রের পালাবদলে আসে গ্রীষ্ম উষ্ণতা নিয়ে। প্রখর তাপে আকাশ তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে । মানব মনও তৃষিত হয় প্রকৃতিকে বরণ করতে, স্মরণ করতে। এরই মাঝে বেজে ওঠে চৈত্রের বিদায় ও বৈশাখের আগমনী সুর। পুরনো কলকাতাও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই সময়ে কলকাতার বুকে ধূমধাম করেই গাজন উৎসব পালিত হত। গাজন আসলে একটি লোক উৎসব।
এ উৎসবের মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পত্নীরূপে কল্পিত পৃথিবীর বিবাহ দেওয়া। গাজন উৎসবের পিছনে কৃষক সমাজের একটি সনাতনী বিশ্বাস কাজ করে। চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্যের যখন প্রচন্ড উত্তাপ থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমণ ও বৃষ্টি লাভের আশায় কৃষিজীবী সমাজ বহু অতীতে এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিলেন। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উৎসব। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এইদিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূণ্যকর্ম বলে মনে করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক। চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। এই উপলক্ষ্যে পুরনো কলকাতায় তখন একগ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু করে অন্য শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হত, একজন শিব ও একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলে।
পুরনো কলকাতার সময় কাল থেকেই প্রচলিত আছে নানা কথন। এই সময়ে শিব সম্পর্কে নানারকম লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করা হয়, যাতে শিবের নিদ্রাভঙ্গ থেকে শুরু করে তার বিয়ে, কৃষিকর্ম ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকে। এই মেলাতে সাধারণত শূলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শি গাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঘোরা, আগুনে হাঁটা প্রভৃতি সব ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য দৈহিক কলাকৌশল দেখানো হয়। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ধরণের খেলা এখন একেবারেই কমে গেছে। পুরনো কলকাতা সহ গ্রামাঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরী বিভিন্ন ধরণের তৈজসপত্র ও খেলনা কেনা বেচা হয়। বায়োস্কোপ, সার্কাস, পুতুল নাচ, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থাও থাকে। পুরনো কলকাতায় এই মেলা তিন থেকে চারদিন চলে। বাঙালী যে দিন চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব পালন করে থাকে সেদিন আদিবাসীরা পালন করে থাকেন তাদের বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান–বৈসাবি ।
Discussion about this post