“কালী ঘাটের কালি তুমি, কৈলাসে ভবানী; বৃন্দাবনে রাধা প্যারির গোকুলে গোপিনী; পাতালেতে ছিলে মাগো হয়ে ভদ্রকালী কত দেবতা করেছে পুজো দিয়ে নরবলি।” বছরে অন্তত দু’বার বহু দূর দূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ শান্তিপুরে ছুটে আসেন। একবার রাস উৎসবে আরেক বার দীপান্বিতা কালী পুজোয়। শান্তিপুরের প্রাচীন কালী পুজোর মধ্যে অন্যতম হল চাঁদুনি বাড়ির কালী পুজো।
মায়ের এমন নামে আছে অনেক মত পার্থক্য। অনেকের মতে ছাঁদুনি নামটি এসেছে চাঁদনি থেকে আর চাঁদনি মানে হল জ্যোৎস্না। দুর্গাপুজোর শেষে দুর্গা দেউলেই শুরু হয় মায়ের কাঠামো গড়া। প্রতি অমাবস্যায় এখানে মাকে শক্তিরূপে পুজো করা হয়। কালী পুজোর দিন মা চাঁদুনিকে দুর্গা দেউল থেকে বাতাস করতে করতে কালীমন্দিরে আনা হয়। একসময় এখানে মোষ বলি হত। তা বন্ধ হয়ে এখন হয় পাঁঠাবলি। শাক্ত ও বৈষ্ণবের মিলনভূমি শান্তিপুর, মতিগঞ্জ মোড় এবং বড়বাজার বাসস্ট্যান্ডের মধ্যবর্তী স্থানে রাস্তার ধারে বাঁ দিকে এই চাঁদুনী মায়ের মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দির-গাত্রের ফলক থেকে জানা যায় মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাকাল ৮৯২ বঙ্গাব্দ। প্রতিষ্ঠা কালে মন্দিরটি গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলে থাকলেও সময়ের সাথে সাথে এটি বর্তমানে নদী থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। মন্দিরের উল্টোদিকে এখন বর্ষাকালে সেই পরিত্যক্ত নদীতে জল উপচে ওঠে।
শান্তিপুরের কাশীনাথ মুখোপাধ্যায় ও ভাই গোপীনাথ মুখোপাধ্যায় তন্ত্রসাধনা করতেন। কাশীনাথ ও গোপীনাথ পরবর্তীতে পান্ডিত্য অর্জন করে সার্বভৌম উপাধি পান। এমনও কথিত আছে, মাতৃসাধক কৃষ্ণানন্দ ও আগমবাগীশের বংশধর তান্ত্রিক যোগী কাছিমা ভট্টাচার্য গঙ্গায় ডুব দিয়ে কুম্ভক যোগে মায়ের আরাধনা শুরু করেন। আবার কেউ বলেন, কাশীনাথ সার্বভৌম এই পুজো শুরু করেন, শৈশবে কাশীনাথ নিজের মায়ের কাছে আবদার করে মাটি দিয়ে কালীমূর্তি তৈরী করান এবং কাশীনাথ সেই মূর্তি পুজো করেন। এখনও সেই প্রথা মেনে চলে ওই বাড়ির কালীপুজো।
কথিত আছে আজ থেকে প্রায় ২২ পুরুষ আগে এই পরিবারের আদিপুরুষ গোপীনাথ সার্বভৌম একদিন পুজোর জন্য তিনি বাগানে ফুল তুলছিলেন। ঠিক এমন সময় একটি ছোট মেয়ে এসে তাঁর কাছে প্রসাদ চায়। গোপীনাথ তাঁকে পুজোর পরে প্রসাদ দেওয়ার কথা দেন। কিন্তু মেয়েটিও নাছোড়বান্দা। এতে তিতি বিরক্ত হয়ে গোপীনাথ মেয়েটিকে দূর করে দেন। পুজো শেষে গোপীনাথ প্রসাদ নিয়ে মেয়েটির অনেক খোঁজ করলেও তার আর সন্ধান পাননি। সেই রাতেই গোপীনাথ স্বপ্নাদেশ পান সেই মেয়েটির, “তোর বাড়ির অদূরে এক কূর্মপীঠ আছে, সেখানে পঞ্চমুন্ডির আসনে আমাকে পুজো কর। তুই যে মন্ত্রে আমাকে পুজো করবি সেই মন্ত্রেই আমি সন্তুষ্ট হব।” তিনি যে স্বয়ং মা কালী। গোপীনাথ মায়ের কাছেই আদেশ পান কার্তিকী অমাবস্যা রাতে বাড়ির কাছেই পঞ্চমুণ্ডির আসনে ‘মা চাঁদুনী’ নামে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে পুজো করার। পর দিন গোপীনাথ সেই স্বপ্নের কথা তাঁর মাকে জানান। তাঁর মা ধীরে ধীরে সেই মূর্তি নির্মাণ করে দেন। বাড়ির কাছেই বেল গাছের নীচে পঞ্চমুণ্ডির আসনে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তন্ত্র মতে পূজা করতেন গোপীনাথ।
এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের কালীপুজোর আলাদা পুঁথি আছে যা গোপীনাথেরই লেখা। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী বংশের বড় বউ কাঠামোতে প্রথম মাটি দিয়ে এর রীতির শুভারম্ভ করেন। বিজয়া দশমীর দিন শুরু হয় মূর্তি গড়ার কাজ, যা শেষ হয় কালীপুজোর আগের দিন। চাঁদুনি মাকে ডাকের সাজে সাজানো হয়। কালীপুজোর আগের দিন জবাকুসুম তেল দিয়ে চাঁদুনী মায়ের কেশসজ্জা করেন বাড়ির সব ছেলেরা। সব থেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল চাঁদুনি মাকে মোমের দুটি মালা পরানো হয়, একটি লাল এবং একটি বেল গোলাপের। সোনার কামরাঙার মটরমালা থেকে শুরু করে সোনার শাঁখা বাঁধানো, নোয়া বাঁধানো, রতনচুড়, হাতপদ্ম, কোমরবন্ধনী, বাজুবন্ধ, পুষ্পহার, সীতাহার ইত্যাদি সমস্ত রকমের স্বর্ণালংকার এবং রৌপ্যালংকারে মাকে সাজানো হয়। মায়ের বুকে থাকে সোনার প্রজাপতি।
চাঁদুনী মাকে দুর্গাদালান থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় ক্ষীরের মিষ্টি খাওয়ানো হয়। মাথায় রুপোর ছাতা ধরে তাঁকে মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার পর পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসানো হয়। চন্ডিপাঠ হয় আর হয় খাঁড়া পুজোও। নিশিরাতের এই পুজোতে বয়ঃজেষ্ঠ্যরা মায়ের আরাধনা করেন। চাঁদুনি মাকে নিরামিষ ভোগ প্রদান করা হয় যাতে থাকে আট রকমের ভাজা, পোলাও, খিচুড়ি, সাদা ভাত, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি ইত্যাদি। ময়রা দিয়ে গজা, পাকান্ন তৈরি হয়। মায়ের গোটা ফলের নৈবেদ্য হয় ও বারোমাস সমস্ত রকমের ফলমূল, শাকসব্জি মায়ের আরাধনায় নিবেদন করা হয়।
চিত্র ঋণ – শুভদীপ রায় চৌধুরী
Discussion about this post