“কলকাতা, তুমিও হেঁটে দেখো কলকাতা”। কখনও ভিক্টোরিয়া, কখনও উল্টো দিকের সুবজ ময়দান, কখনও সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল আবার কখনও প্রিন্সেপ ঘাট। সত্যিই শহর কলকাতার চূড়ায় যেন সবসময়ই বসে রয়েছে তিলোত্তমার জ্বলজ্বলে মুকুটটি। আর সেই রূপের নাগাল পেতে কোনো ওলা উবের নয় পা ফেলতে হবে পিচের শৌখীন রাস্তায় কিংবা উঁচু ফুটপাতের কংক্রিটে। দু’পাশের সাজানো ইমারতগুলোও হয়ত তখন হেঁটে চলবে আপনারই সঙ্গে। অজানা ইতিহাসের পোড়ো গন্ধগুলো হয়ত তখন ভুরভুর করে এসে ঠেকবে নাকে। আর কান পাতলেই শোনা যাবে রঙবেরঙের বনেদি কাহিনীর ফিসফিসানি। উত্তর কলকাতার বুকে তেমনই এক অতিপরিচিত সড়ক হল বি.কে পাল এভিনিউ। কী ওমনি কিছু চেনা স্মৃতির মোড়ক খুলল তো! চলুন না আজ তবে জেনে নেওয়া যাক কে এই বি.কে পাল আর কেনই বা তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ল এই মহানগরীর রাজপথে!
১২ বছর বয়সে জন্মভিটে ছেড়ে শোভাবাজারের মামার বাড়িতে মাথা গুঁজেছেন লোকটা। মামার সাথে মশলার দোকানেই ঘটল ব্যবসার হাতেখড়ি। তুখড় ব্যবসায়িক বুদ্ধি রপ্ত করে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই সাজিয়ে ফেললেন নিজের একটা দোকান। আফিমের ব্যবসায় পয়সা রোজগার তরতরিয়ে এগোলেও মানসিক অপরাধবোধে ভেঙে পড়লেন তিনি। তড়িঘড়ি ওই পাঠ গুছিয়ে তাই বৈদ্যবাটিতে শুরু করলেন পাটের ব্যবসা। আর ঠিক সেই সময় তাঁর নজর পড়ল বিদেশী এলোপ্যাথি ওষুধের দেশি বাজারে রমরমা বাণিজ্য। চাহিদার পারদে কীভাবে চড়চড় করে উঠছে ওষুধ বিক্রেতাদের মুনাফা। ব্যস নেমে পড়লেন ওষুধ ব্যবসায়। বিদেশী এজেন্টদের সাথে যুক্ত হয়ে কলকাতার বুকে গড়লেন ওষুধের দোকান “বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোম্পানি। এমনকি ব্রিটিশদের নাকের ডগায় বসেই বটকৃষ্ণবাবু দোকানের বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে দিলেল পত্রিকা ও খবরের কাগজের পাতায়। ৩০নং, শোভাবাজার স্ট্রীটে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল তাঁর এক মেহনতি প্রাসাদ। শশীভূষণ সুর লেনে বসালেন রিসার্চ ল্যাবরেটরি। চিকিৎসাবিদ্যার জন্য ১৬ টি বিভাগ এবং পশুচিকিৎসার একটি বিভাগ তৈরী হল তাঁরই অনুদানে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যবসায়ী মহলের এক মাইলস্টোনে পরিণত হলেন এই বাঙালি ব্যবসায়ী বি.কে পাল।
তবে শুধুই বটকৃষ্ণবাবু নন উত্তরসুরি দুই ছেলেও ব্যবসাটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন আজও বাঙালি ঐতিহ্যের মাপকাঠিতে। ১৯৩০ সালে পেলেন ‘নাইট’ উপাধির গৌরবময় সম্মান। বিদেশী পত্রিকাতেও ছাপ ফেলল বটকৃষ্ণ পালের সাধারণ উপায়ে ওষুধ তৈরীর বিশেষ কৌশল। শুধু অর্থ উপার্জনে নয় তাঁর খ্যাতির শিরোনাম ছিল এক সমাজসেবক হিসেবেও। ঊনবিংশ শতক থেকে আজকের একবিংশ শতক মাথা উঁচিয়ে আজও একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই দোকান। যার প্রতি ইটে হয়ত আজও পাওয়া যায় রক্তজল করা এক পরিশ্রমের গন্ধ। যার শরীরে হয়ত টিকে রয়েছে বনেদিয়ানার শক্ত বুনিয়াদ। শোভাবাজার সরণী তাই আজও বি কে পালের মেহনতের অংশ হয়েই অক্ষত।
Discussion about this post