ত্রিপুরা রাজ্যের আদিবাসী ত্রিপুরী জনগোষ্ঠীর জীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা এক ঐতিহ্যবাহী উৎসবের নাম বুইসু। শব্দটি এসেছে ত্রিপুরার আঞ্চলিক ভাষার “বিসি” থেকে, যার অর্থ “বছর”। সেই থেকে বুইসু মানে দাঁড়িয়েছে “নববর্ষ” বা বছরের সূচনার সময়কাল। এটি শুধুমাত্র একটি ক্যালেন্ডার পরিবর্তনের দিন নয়—এটি একটি সাংস্কৃতিক বন্ধন, একটি কৃষিজীবনের ছন্দ, এবং একটি আত্মপরিচয়ের অনবদ্য উৎসব।
উৎসবের মূল তাৎপর্য
প্রাচীন ত্রিপুরা সমাজে জুমচাষ ছিল জীবনের অন্যতম ভিত্তি। বনভূমি বেছে নেওয়া থেকে শুরু করে গাছ কাটার সময় নির্ধারণ, তা শুকিয়ে পুড়িয়ে জমি তৈরি এবং ফসল বোনা—সবকিছুই নির্দিষ্ট সময়ের ওপর নির্ভর করত। তাই বছরের শুরুর সঠিক হিসাব রাখা ছিল অত্যন্ত জরুরি। ফলে বুইসু উদ্যাপন ছিল একধরনের সামাজিক ও কৃষিগত অঙ্গীকার।
বুইসু পালনের দিনক্ষণ ও ধরণ
বুইসু সাধারণত চৈত্র মাসের শেষ দিনে পড়ে—১৩ এপ্রিল (বা অধিবর্ষে ১৪ এপ্রিল)। এই উৎসবটি দুই দিনব্যাপী উদ্যাপিত হয়—
১ম দিন: হারি বুইসু
উৎসবের প্রথম দিনে শিশু-কিশোরেরা সকালে বনে গিয়ে পশুদের জন্য বুনো ফুল সংগ্রহ করে। গরু, ছাগল, কুকুর থেকে শুরু করে সব গৃহপালিত প্রাণীকে স্নান করিয়ে, মালা পরিয়ে, টিকা দিয়ে সম্মান জানানো হয়। এই দিনে প্রাণীগুলিকে ভালো খাবার দেওয়া হয় এবং বনেও যেতে দেওয়া হয়। ত্রিপুরা সমাজে পশুদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হয়, কারণ কৃষি ও গৃহস্থালির বহু কাজ তাদের উপর নির্ভরশীল।
২য় দিন: মহা বুইসু
এই দিনটি হলো উৎসবের মূল আকর্ষণ। উৎসবের প্রস্তুতি বহু দিন আগে থেকেই শুরু হয়। গৃহস্থালির মহিলারা রিগনাই, রিসা ও রিকুটু বোনেন, যা তারা নিজে পরিধান করেন এবং পরিবারের বাকি নারী সদস্য ও জামাইদের উপহার দেন। বাড়ি-ঘর পরিষ্কার করা হয়, ভাঙা জিনিস ফেলে দেওয়া হয়।
বহু রকমের কেক তৈরি করা হয়—যার অন্যতম আওয়ান, আওয়ান ব্যাংউই, এবং চুয়ান। নারীরা ভোরে উঠে কেক রান্না করেন, সুস্বাদু খাদ্য তৈরি করেন। অনেক পরিবারে দেবতাকে লাম্বরা পূজা দিয়ে বছরের কল্যাণ কামনা করা হয়। জামাইদের বিশেষ আতিথ্য দেওয়া হয়, পরিবারে সদ্য বিবাহিতা নারীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। দুপুরে একত্রে সবাই আনন্দ-ভোজনে মিলিত হন—গান, নাচ, পানাহার, কথোপকথনে মেতে ওঠেন সবাই।
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
বুইসু শুধুমাত্র একটি কৃষিভিত্তিক উৎসব নয়, এটি একত্রিত করে ত্রিপুরা সমাজের আত্মিক বন্ধন। নতুন বছরের শুরুতে পুরনো দুঃখ ভুলে সবাই নতুন আশা ও আনন্দে মাতেন। বুইসুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গরিয়া পূজা-র সূচনাও, যা আবার সাত দিনের এক দীর্ঘ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
ত্রিপুরার বুইসু উৎসব শুধুমাত্র একটি নববর্ষ নয়—এটি এক আত্মপরিচয়, একটি জীবনের ছন্দ, এবং একটি সমাজের আনন্দঘন মিলনক্ষেত্র। যেমনটি ত্রিপুরার মানুষ বলেন—“বছরে একবারই তো বুইসু আসে, কে জানে আবার দেখা হবে কিনা!” তাই এই দিনটিকে তাঁরা পালন করেন সর্বোচ্চ উৎসাহে, সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা আর সর্বোচ্চ আনন্দে।
Discussion about this post