নাৎসি বাহিনী, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, নির্মমতা…সব একই সারণীর শরীক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভৎসতা ইতিহাসের বই এর পাতার বাইরেও অনেক বেশি বীভৎস। নাৎসী বাহিনী পরিচালিত এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও বেশি। ইহুদি জাতি ছাড়াও নাৎসী বিরোধী কর্মকর্তাদের ধরে ধরে তুলে আনা হত ক্যাম্পে। নিষ্ঠুরতার চরম পর্যায়ের সাক্ষী থেকেছে এই ক্যাম্পগুলো। সেরকমই একটি, বুখেনভাল্ড কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
বুখেনভাল্ড কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, নাৎসি বাহিনীর অন্যতম বৃহৎ নির্মমতার শিবির। জার্মানিতে অবস্থিত এই ক্যাম্পে একসময় বন্দী সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ৮০ হাজার! এবং নির্মমতার বলি হয়ে মারা গিয়েছেন ৫৬ হাজার ৫৪৫ জন! নাৎসীদের অন্যান্য কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের তুলনায় কিছুটা আলাদা এর প্রবেশ দ্বার। অন্যান্য ক্যাম্পের দরজায় জার্মানি ভাষায় লেখা “Arbeit Macht Frei” যার অর্থ “কর্মেই মুক্তি”। কিন্তু বুখেনভাল্ড ক্যাম্পে লেখা “Jedem Das Seine” অর্থাৎ “যে যেমন সে তেমন”। তবে ইংরেজিতে এখানে আরেকটি অনুবাদ ছিল “তার যেটা প্রাপ্য, সে তাই পাবে।” অর্থাৎ নাৎসীরা খুব ভালো ভাবেই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল, এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে একবার প্রবেশ করলে মুক্তির কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা বন্দিরা যতোই কঠোর পরিশ্রম করুক না কেন!
স্যাচেনহাউজেন এবং অসউৎজে নিযুক্ত জার্মান আধাসামরিক বাহিনীর অন্যতম কর্মকর্তা রুডলফ হসের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, নাৎসী বিরোধী অরাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও পাঠানো হত এখানে। তারা শারিরীক পরিশ্রমের উপযুক্ত হলে প্রাথমিকভাবে ছয়মাসের জন্যই বরাদ্দ ছিল তাদের বন্দিজীবন। তারপর তাদের মুক্তি। কিন্তু কমিউনিস্ট এবং সাম্যবাদী গণতন্ত্রপন্থীরা ছিল নাৎসীদের চোখে ক্ষমার অযোগ্য! তাদের শাস্তি ভোগ করতে হতো সারাজীবন! ১৯৩৭ এ তৈরি বুখেনভাল্ড ক্যাম্পটির স্থানও বাছাই করা হয়েছিল যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করেই। উঁচু পাহাড়ি ঢালের উত্তর প্রান্তে ছিল এর অবস্থান। ফলে ক্যাম্পের নিরাপত্তা কর্মীরা নিজেদের ঘরের জানলা দিয়ে খুব সহজেই লক্ষ্য রাখতে পারত ক্যাম্পের মূল প্রবেশদ্বারে।
ক্যাম্পে আসা নতুন বন্দীদের জন্য ছিল জীবাণুমুক্তকরণ ভবন। মূল ক্যাম্পে প্রবেশের পূর্বে কামিয়ে দেওয়া হতো তাদের পুরো শরীর। তারপর তাদের ডুবিয়ে রাখা হতো জীবাণুনাশক তরলে। ক্যাম্পে যাতে কোনো রোগ না ছড়ায় তাই এই ব্যবস্থা! আবার মূল ক্যাম্পটি ছিল দুইভাগে বিভক্ত। বন্দীরা যাকে বলত বড়ো ক্যাম্প এবং ছোটো ক্যাম্প। ছোটো ক্যাম্পটি ছিল পোল্যান্ডের কুখ্যাত বারকিনাউ ক্যাম্পের আদলে তৈরি। ভিড়ে গাদাগাদি করে এখানে রাখা হতো রোগে ভোগা কয়েদিদের। ফলে ছোটো ক্যাম্পের জ্যান্ত মানুষের ভাগাড়ে পরিণত হতে সময় বেশি লাগেনি!
ক্যাম্পের ভিতরেই ছিল মানুষ পোড়ানোর চুল্লি। বন্দীদের চোখের সামনে দিয়েই সেখানে নিয়ে যাওয়া হতো তাদের আরেক সঙ্গীকে! সেখানে জ্যান্ত কিংবা অর্ধমৃত অবস্থাতেই ব্যবচ্ছেদ করা হতো শরীরের অঙ্গ! পরবর্তীতে এখানে পাওয়া গিয়েছে মানুষের চামড়ার তৈরি প্রদীপের ঢাকনা এবং সংকুচিত করে ফেলা মানুষের খুলি। ইহুদি বন্দীদের চর্বি দিয়েই তৈরি করা হতো সাবান! এমনি অমানুষিক অত্যাচারের সাক্ষী এই ক্যাম্প। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫০ সালে বিষ্ফোরকে উড়িয়ে দেয় এই যন্ত্রণা কেন্দ্র। ফলে বর্তমানে এই ক্যাম্প স্মৃতিসৌধ মনে হলেও, আসলে মানুষে ঔদ্ধ্যতা আর নিষ্ঠুরতার প্রতীক ছাড়া আর কিছু নয়।
তথ্য ঋণ – শর্মিষ্ঠা দে
Discussion about this post