বাঙালির সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চার সম্পর্ক অনেকেই সিনেমা বা সাহিত্যের মধ্যেই খুঁজে দেখতে চান। তাদের বিশ্বাস এই ক্ষেত্রগুলির বাইরে বেপরোয়া দুঃসাহসের নমুনা বোধহয় বাঙালি জাতির নেই। তবে এমন ধারণা ইতিহাসের পাতায় ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন বা বীর সুভাষের কিংবদন্তীতে পরিণত সংগ্রামের সঙ্গে পরিচিত হয়ে। তবে ইতিহাসের জোরালো আলোর আড়ালে থেকে যায় এমন অনেক নাম যাঁদের জীবন কাহিনী একটা দুর্দান্ত যাত্রা, একটা অবিশ্বাস্য অ্যাডভেঞ্চার। পাদপ্রদীপের আলোর আড়ালে তেমনই একজন ব্যক্তিত্ব হলেন বাংলার বিস্ময় সুরেশ বিশ্বাস। যাঁর জীবন কাহিনী এক কথায় চূড়ান্ত অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর অভিযান।
১৮৬১ সালে নদীয়া জেলার মথুরাপুর গ্রামে সুরেশ বিশ্বাসের জন্ম হয় এক অতি সাধারণ পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই সুরেশ বিশ্বাস ছিলেন চনমনে, দুষ্টু ও সাহসী। পরবর্তীকালে এক ইংরেজ সাহেবের কল্যাণে সুরেশ বিশ্বাস লন্ডন মিশন স্কুলে ভর্তি হন। চোদ্দ বছর বয়সে সুরেশ বিশ্বাস খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। পরিবারের চরম দৈন্যদশার কারণে খুব অল্প বয়সেই হোটেলের ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবে জীবিকা উপার্জন শুরু করেন সুরেশ বিশ্বাস। এরপর ভাগ্যের অন্বেষণে সুরেশ চেপে বসেন মায়ানমারের জাহাজে। ভাগ্য প্রসন্ন না হলেও মায়ানমারে বীরত্বের পরিচয় দেন অকুতোভয় সুরেশ। আগুনের কবল থেকে সুরেশ রক্ষা করেন একজন স্থানীয় ভদ্রমহিলাকে। মায়ানমারের অধ্যায় শীঘ্রই সমাপ্ত হওয়ায় তরুণ সুরেশ প্রথমে মাদ্রাজ এবং সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন।
অভিযানের অমোঘ টান পিছু ছাড়েনি সুরেশের। সহকারী স্টুয়ার্ড পদে যোগদান করে সতেরো বছর বয়সে সুরেশ পাড়ি দেন বিলেতে। থাকতে শুরু করলেন লন্ডন শহরের ইস্ট এন্ডে। মুটে মজুরী ও সংবাদপত্র বিলি ছিল তখন পেট চালানোর মাধ্যম। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের গ্রামে গ্রামে ফেরি করে মোটামুটি উপার্জন করার পাশাপাশি সুরেশ বিশ্বাস গণিত, রসায়ন, ল্যাটিন, গ্রিক ও জাদুবিদ্যা রপ্ত করে ফেলেন। কিছু মাস অতিবাহিত হওয়ার পর কেন্ট প্রদেশের একটি সার্কাস কোম্পানিতে যোগদান করেন সুরেশ বিশ্বাস পনেরো শিলিং মাইনের বিনিময়ে। শিখে ফেলেন সার্কাসের জন্য উপযোগী জিমন্যাস্টিকের কলা কৌশল। বাঘ-সিংহের সঙ্গে নিয়মিত চলে দ্বৈরথ। ভয়ডরহীন বাঙালির খেলায় মজে ওঠেন দর্শককূল সঙ্গে এক জার্মান তরুণী। প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া সুরেশের ভালোবাসার মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বাবার অসুস্থতার জন্য তরুণী জার্মানির উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন।
ভবঘুরে সুরেশের বিচ্ছেদ তার অ্যাডভেঞ্চারে বিরাম টানেনি। ১৮৫৫ সালে সার্কাসের দল পৌঁছয় আমেরিকা। তুমুল সাড়া জাগিয়ে মার্কিন মুলুক থেকে মেক্সিকো ও সেখান থেকে সুরেশ বিশ্বাস ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেইরোর মাটি স্পর্শ করেন। জনপ্রিয়তা ও সাফল্য দুটোই অর্জন করেন এই বাঙালি পুরুষ। ১৮৮৬ সালে সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে নিযুক্ত হন রিও শহরের রাজকীয় পশুশালায়। ঠিক তার পরের বছরই ব্রাজিলের অশ্বসেনার কর্পোরাল পদে নিযুক্ত হন। এই পদে থাকাকালীন সুরেশ বিশ্বাস শিখে ফেলেন শল্য চিকিৎসার কৌশল। উন্নীত হন সার্জন পদে। ১৮৯৩ সালে যখন শিকাগোতে বাঙালির নাম উজ্জ্বল করছেন স্বামী বিবেকানন্দ, একই বছরে আরেক বাঙালি সুরেশ বিশ্বাস ব্রাজিল সেনার লেফটেন্যান্ট পদে অভিষিক্ত হন। যে নবীন প্রাণ একদিন অর্থাভাবে জাহাজ ধরেছিল ব্রহ্মদেশের, সেখান থেকে প্রথম বিশ্বের অচেনা দেশের সেনার শীর্ষস্থানীয় পদে অভিষেক একটা দুর্দান্ত অবিশ্বাস্য কাহিনী। বিয়ে করেন স্থানীয় এক চিকিৎসকের মেয়েকে। কর্ম জগৎ ও সংসারে থিতু হলেন অবশেষে পায়ের তলায় সরষে নিয়ে দুনিয়া কাঁপানো সুরেশ বিশ্বাস। সদা চঞ্চল প্রাণ পৃথিবীতে থিতু হওয়া মানতে না পেরে পরলোকে পাড়ি দেন ১৯০৫ সালে।
Discussion about this post