কালীক্ষেত্র ও রাস উৎসবের জন্য বিখ্যাত শান্তিপুর শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের এক প্রাচীন জনপদ ব্রহ্মশাসন। এককালে এই এলাকা দিয়ে ভাগীরথী নদী প্রবাহিত হত। কালের নিয়মে ভাগীরথী গতিপথ বদলালেও, এই এলাকাটা আগের মতই রয়েছে সবুজে ঘেরা। শান্তিপুরের এই প্রত্যন্ত জনপদটা প্রতিবছর জেগে ওঠে জগদ্ধাত্রী পুজো এলেই। কথিত আছে, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের হাত ধরে বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হলেও, এই ব্রহ্মশাসন গ্রামেই নাকি প্রথম দেবী জগদ্ধাত্রীর মৃন্ময়ী রূপের পুজো হয়েছিল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নাতি গিরিশচন্দ্র রায় তার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত শান্তিপুরের হরিপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী এই অঞ্চলে ১০৮ ঘর ব্রাহ্ম পরিবারকে বসবাসের জায়গা দিয়েছিলেন। আর সেখান থেকেই এই গ্রামের নাম হয়েছিল ব্রহ্মশাসন।
১৭৬৩ সালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে নদীয়ার রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয়েছিল। তবে, সেই সময় কিন্তু দেবী জগদ্ধাত্রীর কোন মৃন্ময়ী রূপের ধারণা ছিলনা। সেই কারণে ১৭৬৩ থেকে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শুধুমাত্র মঙ্গল ঘট স্থাপনের মাধ্যমেই দেবী জগদ্ধাত্রী পুজো হতো কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে। এরপর ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নাতি গিরিশচন্দ্র রায় যখন নদীয়ার অধিপতি হন, তখন কৃষ্ণনগর রাজসভায় সভাপন্ডিতের পদ অলংকৃত করতেন চন্দ্রচূড় তর্কচূড়ামণি। সেই ১০৮ ঘর ব্রাহ্মদের মধ্যে চন্দ্রচূড় তর্কচূড়ামণি ছিলেন অন্যতম। তিনি ব্রহ্মশাসন গ্রামেই বসবাস করতেন এবং ভাগীরথীর তীরে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে তন্ত্রসাধনা করতেন। সেই সময় পর্যন্ত দেবী জগদ্ধাত্রীর কোন নির্দিষ্ট রূপ এবং পুজোর পদ্ধতি বা মন্ত্র জানা ছিল না। সেই কারণে গিরিশচন্দ্র চন্দ্রচূড়কে অনুরোধ করেন, যেন তিনি সাধনার মাধ্যমে দেবী জগদ্ধাত্রী রূপের সন্ধান এবং পুজোর জন্য প্রয়োজনীয় মন্ত্রের অন্বেষণ করেন।
সেইমতো ধ্যানে বসেন চন্দ্রচূড়। সাধনায় বসে একদিন ব্রাহ্ম মুহূর্তে দেবীর মৃন্ময়ী রূপের দর্শন পান চন্দ্রচূড়। দেবীর গায়ের রং ছিল ব্রাহ্মমুহূর্তের রং অর্থাৎ ঊষাকালে সূর্যের রঙের মতো এবং দেবী ছিলেন সিংহবাহিনী চতুর্ভূজা। কথিত আছে, সেই সাধনাতেই পুজোর পদ্ধতি এবং মন্ত্রের হদিশও পেয়েছিলেন চন্দ্রচূড়। আর সেই পদ্ধতি মেনেই ব্রহ্মশাসন গ্রামে দেবী জগদ্ধাত্রীর মৃন্ময়ী রূপের পুজো করেন চন্দ্রচূড়। এরপর সেই একই পদ্ধতি মেনে ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে শুরু হয় দেবীর মৃন্ময়ী রূপের আরাধনা। এখনো সেই একই চিরাচরিত পরম্পরা মেনে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে আসছে ব্রহ্মশাসন সহ শান্তিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে। পাশাপাশি, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নাটমন্দির থেকে শুরু করে পরবর্তীতে এই পুজো ছড়িয়ে পড়েছে চন্দননগর থেকে বাংলার এবং বাংলার বাইরের আপামর বাঙালি সমাজের কাছে।
Discussion about this post