বাঙালির পয়লা বৈশাখের রোজনামচা বছরের আর পাঁচটা দিনের চেয়ে একটু আলাদা। রোজকার দশটা-পাঁচটা ভুলে, এ দিনটা একটু অন্যরকম তো হবেই। ভোর ভোর ঘুম থেকে ওঠে গঙ্গায় স্নান৷ এরপর নতুন কাপড়ে শুদ্ধ চিত্তে লক্ষ্মী-গণেশের সামনে জোড় হাতে বসে পড়া৷ পুজো শেষে মিষ্টি মুখ৷ দুপুরে বাঙালি রান্নার আড়ম্বর৷ বিকেলে একটু ভাত-ঘুম৷ সন্ধ্যায় দোকানে দোকানে ঘুরে হালখাতা। একগাদা মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার নিয়ে বাড়ি ফিরে আসা৷ মাঝে কোথাও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে টুক করে কোথাও একটা বসে আড্ডা সেরে ফেলা।
তবে ওপার বাংলার বাঙালিদের মধ্যে পয়লা বৈশাখ নিয়ে উদ্দীপনা বোধহয় ভালোই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় এপারের দিকে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের জয়রামপুর গ্রামের বউরা স্বামী সোহাগিনী হতে বছরের পর বছর ধরে ছুটে আসে এই পুজোয়। এ দিন রেকাবি ভরা বৈশাখী ফলের ভোগের সাথে পায়রা ওড়ানো হয় বৃক্ষ দেবতার উদ্দেশ্যে। এই বটতলার মেলায় অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই নারী। সাধারণত বৈশাখের দ্বিতীয় দিন থেকে এই পুজোর শুরু। এই বৃক্ষটি সিদ্ধেশ্বরী কালীতলা নামেও পরিচিত কিন্তু স্থানীয়রা এটিকে বউতলা বলে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ৯৩ বছর ধরে সোনারগাঁও পৌরসভার জয়রামপুর গ্রামে ৪০০ বছরের পুরনো বট গাছের নিচে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বউরা জড়ো হতেন। গৃহবধূরা এ মেলায় অংশ নেয় বলে মেলাকে নাম দেওয়া হয়েছিল বউ মেলা। এই বটবৃক্ষের নীচে পুজো হয়, তা স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে হয়ে উঠেছে পুণ্যের দেবতা। তাই স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বটবৃক্ষটি সিদ্ধেশ্বরী দেবতা নামে সুপরিচিত৷ রেকাবি ভরা বৈশাখী ফলের ভোগ নিয়ে দলে দলে নারীরা হাজির হন বউ মেলায়। দেবতার সন্তুষ্টির জন্য এখানে আগে বলি দেওয়া হত৷ তবে এখন সেই প্রথা বিলুপ্ত। বরং শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে ওড়ানো হয় পায়রা। শোনা যায়, স্বামী সংসারের বাঁধন যেন অটুট থাকে সারা বছর সুখ শান্তিতে যেন কাটে দাম্পত্য জীবন। এই কামনাতেই পুজোর আয়োজন করেন নারীরা।
পুজোকে কেন্দ্র করেই বটবৃক্ষের পাশের মাঠে বসে বিরাট মেলা৷ স্থানীয় মানুষজনের পাশাপাশি অন্যান্য জেলার মানুষও জড়ো হন এই মেলায়৷ তবে, সময়ের পালা বদলে এ ‘বউ মেলা’ এখন তার অতীত জৌলুস অনেকটাই হারিয়ে এখন বর্ণহীন। মেলার জন্য পর্যাপ্ত স্থান না থাকার কারণে মেলায় আগত দর্শনার্থীদেরকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামগঞ্জে পালিত হওয়া ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলো এখন বিলুপ্তির প্রায় পথে। সেখানে শিবরাত্রির সলতের মতো এখনও জিইয়ে রয়েছে সোনারগাঁওয়ের ‘বউমেলা’৷
Discussion about this post