রায়মঙ্গলের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আর নিবিড় অরণ্যের সবুজ শ্যামলিমা যদি সুন্দরবনের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয় ঠিক এর উল্টো পিঠেই রয়েছে নদী আর অরণ্যে মোড়া দ্বীপবাসীর কঠিন জীবন সংগ্রাম। বিলাসবহুল বোটের ডেকে বসে সুন্দরী, গরান, গেওয়া ঘেরা জঙ্গলের সূর্যাস্ত উপভোগ, ভ্রমণ পিয়াসী বাঙালির কাছে রোমান্টিসিজম হলেও সুন্দরবনের মানুষের কাছে নদী বা জঙ্গল মোটেও সুখকর কিছু নয়। কারণ ক্রমাগত নদী ভাঙ্গন যখন আচমকা বাসস্থান কেড়ে নেয়, জীবিকার তাগিদে যাওয়া জঙ্গল যখন প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণ হয়, জলে জঙ্গলের কাব্য তখন “ক্ষুধার রাজ্যে ঝলসানো রুটি” সম মনে হয়। তা সত্ত্বেও জীবন ও জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনের মানুষকে বারে বারে যেতে হয় জঙ্গলের দ্বারে। কারণ এখনকার অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো নদীর মাছ, জঙ্গলে মধু,মোম,কাঠ আর হোগলা পাতা। তাই ঝুঁকি সত্ত্বেও এখানকার মানুষদের প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয় খামখেয়ালি নদীর সঙ্গে, হিংস্র বাঘের সঙ্গে। আর এইসব ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার স্বাভাবিক উপায় গুলি যখন ব্যার্থ হয় তখনি মানুষ আশ্রয় নেয় অলৌকিক বিশ্বাসের কাছে। সুন্দরবনের মানুষের সেই বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় বাংলার আর এক লোকদেবী ‘বনবিবি’।
লোকগাথা অনুযায়ী রাজা দক্ষিণ রায় হলেন দণ্ডবক্ষ ও রায়মনি নামক রাক্ষস দম্পতির সন্তান। এই দম্পতি সাইত্রিশ কোটি পিশাচ সৈন্য নিয়ে সুন্দরবন দখল করেন। দক্ষিণ রায় ছিলেন প্রবল পরাক্রমী আর অত্যাচারী। তিনি বাঘের রূপ ধারণ করে মানুষের ঘাড় মটকাতেন। অন্যদিকে মক্কার ফকির নিঃসন্তান ইব্রাহিম সন্তান লাভের আশায় দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। দ্বিতীয় পত্নী গোলালমবিবি সন্তানসম্ভবা হলে ইব্রাহিম তাকে জঙ্গলে ছেড়ে আসেন প্রথম স্ত্রীর প্ররোচনায়। গোলালবিবি জন্ম দেন বনবিবি ও শাহ জঙ্গলীকে। সাত বছর পর ইব্রাহিম ভুল বুঝতে পেরে স্ত্রী সন্তানদের মক্কায় ফিরিয়ে আনেন।
একদিন নামাজ পড়ার সময় দুই ভাইবোন অজান্তে দুটি যাদু টুপি মাথায় দিতেই তারা পৌঁছে যায় আঠারো ভাঁটির দেশে। জঙ্গলে ভাই বোনের নামাজের সুর শুনে দক্ষিণ রায় তো রেগে কাঁই। সিদ্ধান্ত নিলেন সম্মুখ সমরে নামবেন। কিন্তু দক্ষিণের মা রায়মনি বোঝালেন পুরুষ হয়ে নারীর সাথে যুদ্ধ করা মানায় না। তাই তিনি নিজেই এলেন যুদ্ধ করতে। ওমা! লড়াই কী হবে? দুজনের মধ্যে হয়ে গেলো মহা ভাব। দুজনে আপোসে ভাগ করে নিলেন সুন্দরবনকে। বনিবিবি পেলেন মনুষ্য বসতি, আর দক্ষিণ রায় নিলেন গহীন অরণ্য।
“বনবিবি বলে সই শুন দেল দিয়া।
সকল আঠার ভাটি লহিব বাটিয়া।।”
বারিজহাটি গ্রামের দুই ভাই ধনা আর মনা চলেছে জঙ্গলে সাত নৌকো লোক লস্কর নিয়ে। সঙ্গে ছিলো দুখে। কিন্তু অনেক ঘোরাফেরার পরও কাঠ ,মধু কিছুই মেলে না। এই অবস্থায় দক্ষিণ রায় স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলল তাঁর উদ্যেশ্যে মানুষ উৎসর্গ করলেই সব কিছু মিলবে। সেইমতো ধনা, মনা স্থির করলো দুখেকেই ছেড়ে আসবে জঙ্গলে। আর তাতেই তারা পেলো প্রচুর কাঠ,মধু, মোম। আর দুখে মায়ের উপদেশ অনুযায়ী বনবিবির শরণাপন্ন হলো। ডাক শুনে তৎক্ষণাৎ হাজির হলেন বনবিবি আর শাহ জঙ্গলী। বাঁধলো ধুন্ধুমার লড়াই। দক্ষিণ রায় যখন পরাজিত প্রায় তখন বড়াখান গাজী (কুমিরের রক্ষাকর্তা) এসে লড়াই থামালেন। বনবিবি দুখেকে দিলেন সাত গরুর গাড়ি বোঝাই মণিমানিক্য। আর দক্ষিণ রায় দিলেন অনেক মোম আর মধু। বনবিবি তার বাহন সেকোের (কুমির) পিঠে চাপিয়ে গ্রামে ফেরত পাঠালেন। গ্রামে ফিরে দুখে ধনার মেয়ে চম্পাবতীকে বিয়ে করে চৌধুরী উপাধি নেন। সেদিন থেকে সুন্দরবনের সকল ধর্ম ,বর্ণ ,সম্প্রদায়ের মানুষ বনবিবি ও তার পাশে দুখের মূর্তি রেখে ভক্তিভরে পুজা করেন।
জঙ্গলে বনবিবির দুইরকম মুর্তি দেখা যায়। একটিতে মাথায় তার টুপি, চুল বিনুনি করা, কপালে টিকলি, গলায় হার, পরনে পাজামা, পায়ে জুতো, কোলে একটি বালক। কোথাও বাঘের পিঠে, আবার কোথাও মুরগির পিঠে আরুঢ়া। ভক্তজনের বিশ্বাস কোলের ছেলেটি সেই দুখে। অন্য একটি মুর্তিতে দেখা যায়, মাথায় মুকুট, গলায় হার ও বনফুলের মালা, সর্বাঙ্গে নানা অলংকার এবং কোলে বা পাশে দুখের মানব মূর্তি। প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথম দিনে মহা সমারোহে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। পুজো উপলক্ষে সমাজের সর্ব স্তরের মানুষ জমায়েত হন। মেলা বসে উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা সহ বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলিতে।
মেলায় থাকে বিভিন্ন খাবারের দোকান, হাড়িয়া, মোরগ লড়াই ,সার্কাস সহ বিভিন্ন লোক অনুষ্ঠান। মজার ব্যাপার সারা ভারতবর্ষে এটাই বোধহয় একমাত্র পুজো যেখানে হিন্দু মুসলিম উভয়েই এই দেবীর আরাধনা করেন তাও একসাথে, একই বিশ্বাসে। বিশেষত যারা জঙ্গলে কাঠ ,গোলপাতা কাটতে যান, মৌলে(মধু সংগ্রাহক), মৎস্যজীবী, চোরাশিকারী ইত্যাদি মানুষজন জঙ্গলে ঢোকার আগে বনবিবির পুজো করে যান। কারণ প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী বনবিবিই তাদের রক্ষা করেন দক্ষিণ রায়ের হাত থেকে। তাই জঙ্গল এখানকার মানুষের কাছে অতি পবিত্র ভূমি। তাই জঙ্গলের ভেতর এরা কোনো রকম নোংরা, আবর্জনা,থুতু এমনকি মল মূত্রও ত্যাগ করেন না। আসলে এও একপ্রকার বিজ্ঞান চেতনা। আমরা বই পড়ে, টিভি দেখেও যা আমরা শিখতে পারিনা, গ্রাম্য নিরক্ষর মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মেই শিখে যান অরণ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা।
বনবিবির মেলাতে, সারাবছর বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে দুখে যাত্রার আসর বসে। এই দুখে যাত্রা আসলে বাংলার প্রাচীন লোকসংগীত পালা কীর্তনের অংশ। ষষ্ঠী মঙ্গল, মনসা মঙ্গল , পসরা ভাঙা গান ইত্যাদি পালা কীর্তন গুলি মূলত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রচারিত হয়। কিন্তু দুখে যাত্রা সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ এই যাত্রার কুশীলব। আগে অপেক্ষাকৃত কোমল ত্বকের অধিকারী পুরুষরা নারীর চরিত্রে অভিনয় করতেন। কিন্তু যুগের প্রয়োজনে সাবিনা বিবি,রোকেয়া বিবিরা এখন বনবিবির চরিত্রে অভিনয় করেন। যা কিন্তু আসলে নারী স্বাধীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই যাত্রার লিখিত কোনো রূপ সেভাবে নেই, অভিনেতা অভিনেত্রীরা মূলত মুখে মুখে সংলাপ ও গান মনে রাখেন। অভিনয় হয় মঞ্চ বেঁধে। অভিনয় ও সাজসজ্জা দুই-ই চড়া ধাঁচের। বহুশ্রুত এই পালাগান আজও সুন্দরবনের মানুষের কাছে সমান আকর্ষণের। কিন্তু আধুনিকতার করাল গ্রাসে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এই লোকসংস্কৃতি। কেবল, ইন্টারনেটে অভ্যস্ত যুব সমাজ আর কোনো আগ্রহ দেখায় না এই সব সেকেলে গান বাজনায়। এখনি উদ্যোগ না নিলে সুন্দরবনের এই প্রাচীন পালাগান ডিজে রিমিক্সের ভিড়ে হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে সুন্দরবনের সম্প্রীতির দেবী বনবিবি। প্রাচীন বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ এই দেবী বেঁচে থাক জঙ্গলের বিশ্বাসে। শহুরে মানুষের কাছে সুন্দরবন প্রেমী হিসেবে আমন্ত্রণ রইল। চলুন বেড়িয়ে আসি অরণ্যের গহীনে, সঙ্গে করে নিয়ে আসি পরিবেশ রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পাঠ।
প্রতিবেদক সুকমল মাইতি, চিত্র ঋণ সুকমল মাইতি এবং শুভ দে
Discussion about this post