সমুদ্র মন্থনের পরের কথা। মন্থনে উঠে আসা অমৃত স্বর্গের দেবতাদের দিয়ে, নিজে সমস্ত বিষ এক ঢোঁকে পান করেছিলেন শিব। শিব তো আর মানুষ নন, যে বিষ খেলে মৃত্যু হবে। শিব দেবতা। ফলে বিষ আটকে রইল তাঁর গলায়। সারা শরীর হয়ে গেল নীল। তাই শিবের নাম নীলকণ্ঠ। শিব ঠাকুরের ছবিতে, মূর্তিতে সর্বত্রই বাঘ ছাল, জটা আর নীল বর্ণের খোলা শরীর দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু নীল দুর্গা প্রতিমা দেখেছেন? গোটা বাংলায়, একমাত্র নদীয়ার কৃষ্ণনগরে পূজিত হন নীল দুর্গা। একমাত্র দুর্গা পুজোর সময়েই দেখা মেলে তাঁর।
অবিভক্ত বাংলার বরিশালে, চিন্তাহরণ চট্টোপাধ্যায় তাঁদের পরিবারের এই পুজোর সূচনা করেছিলেন। প্রমাণ না পাওয়া গেলেও, তাঁরা মনে করেন পুজোটি ২৯০ বছরের পুরনো। দেশভাগের সময় চট্টোপাধ্যায় পরিবার কৃষ্ণনগরে আসেন। ১৯৪৭ সাল থেকে কৃষ্ণনগরের নাজিরা পাড়াতে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের নীল দুর্গা পুজোর হয়। জীবনলাল চট্টোপাধ্যায় প্রথম কৃষ্ণনগরে এই নীল দুর্গা পুজো করেছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে চট্টোপাধ্যায় পরিবারে শরিকি বিবাদের ফলে পুজো ভাগ হয়ে গেছে। তবে সেই নীল বর্ণের প্রতিমার পুজোর ধারা চলছে এখনও।
এখন প্রশ্ন জাগে দুর্গা প্রতিমার রং নীল কেন? এই নীল প্রতিমা নিয়ে গল্প রয়েছে। কেউ বলেন দেবী নিজেই নাকি স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন এই বলে, যে তিনি নীল বর্ণের অপরাজিতারূপে পূজিত হতে চান। কেউ বলেন যিনি মৃৎশিল্পী ছিলেন, তিনি ভুলবশত নীল রং করে ফেলেছিলেন বুঝতে না পেরে। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর কাহিনীটি হল, বৃদ্ধ শিল্পী রাত জেগে প্রতিমা তৈরির কাজ করছিলেন। একসময় জানলা দিয়ে ভোরের প্রথম নীলচে আলো প্রতিমার মুখে পড়ায় শিল্পী বিভোর হয়ে পড়েন। তিনি স্বজ্ঞানেই নীল রং দিয়ে প্রতিমা রং করেন। তারপর থেকেই এই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গা প্রতিমার রং নীল।
তবে, হিন্দুশাস্ত্রে মার্কেন্ডিয় পুরাণে দুর্গার এই নীল বর্ণের অপরাজিতা রূপের উল্লেখ রয়েছে। শাস্ত্রমতে সেই রীতি অনুযায়ীই আরাধনা করেন পরিবারের সদস্যরা। কৃষ্ণনগরের এই দুর্গা মন্দিরের নামটিও হল ‘নীল দুর্গা বাড়ি’। উল্টো রথের দিন দেবীর পটে মাটি দেওয়া হয়। সন্ধি পুজোর সময় লাগে ১০৮টি অপরাজিতা ফুল। পুজো হয় শাক্ত মতে। প্রতিদিন দেবীকে মাছের ভোগ দেওয়া হয়। প্রতিমা হয় একচালার। সাধারণ প্রতিমার থেকে উল্টো দিকে অর্থাৎ বাম দিকে থাকে সরস্বতী ও গনেশ মূর্তি এবং ডান দিকে থাকে লক্ষ্মী ও কার্তিকের মূর্তি।
Discussion about this post