পুরনো দিনের ডাকাত সর্দারদের কথা আমরা দাদু-ঠাকুমাদের মুখে বা বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে হামেশাই পড়ে থাকি। তারা জঙ্গলে থাকত, মা কালীর আরাধনা করে উল্লাস করতে করতে গ্রামে গিয়ে ডাকাতি করত। ধরা পড়লে কেউ জেল খাটত তিন মাস, কেউ তিন বছর বা কেউ কেউ ছয়-সাত বছর অবধিও। কিন্তু আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে বাংলার বুকে জন্মেছিল এমন এক ডাকাত, যে কি না পেয়েছিল ফাঁসির শাস্তি! শুধু তাই-ই নয়, মৃত্যুর পর গাছের ডালে ঝোলানো হয়েছিল তাঁর দেহ! কিন্তু ডাকাতের এত বড় শাস্তি! কেন? সে কি এতই নৃশংস ছিল! নাকি আড়ালে রয়েছে অন্য কোনো কারণ? সেই ‘বিশে ডাকাত’ কি সত্যিই ছিল ডাকাত, নাকি অন্য কেউ!
ঘটনার প্রেক্ষাপট নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৮৫৯ সালে বাংলার বুকে ঘটা ‘নীল বিদ্রোহ’। ১৭৭৭ সালে বাংলার নদীয়া ও যশোর জেলায় প্রথম নীলচাষ শুরু হয়। তারপর থেকেই বাংলার সহজ-সরল চাষীদের বোকা বানিয়ে ক্রমাগত মুনাফা লুটতে থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। স্থানীয় তোষামোদকারী ও নীলকুঠির দেশীয় কর্মচারীদের ইন্ধনে নীলকর সাহেবরা চাষীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে লাঠিয়াল বাহিনী পর্যন্ত লেলিয়ে দেয় মহিলা ও শিশুদের ওপর। ফলে বিদ্রোহের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয় বাংলার চাষীরা। তাদের অহিংস আন্দোলন অচিরেই সশস্ত্র বিপ্লবের আকার নেয়। এই বিদ্রোহকেই নীলকর সাহেবরা ‘ডাকাতি’ আর বিদ্রোহী চাষিদের ‘ডাকাত’ বলে প্রচার করত। বিশ্বনাথ সর্দার ওরফে ‘বিশে ডাকাত’ ছিলেন তাদেরই একজন। আসলে, তিনিই ছিলেন বাংলার নীলবিদ্রোহের রূপকার ও প্রথম শহিদ!
দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের উদ্দেশ্যে বিশ্বনাথ উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই তাঁতি ও কৃষকদের নিয়ে নিজের একটি দল গঠন করেছিলেন। নদীয়ার শান্তিপুরের কাছে ফুলিয়ার জঙ্গলে ছিল তাঁর আস্তানা। সেখানে গোপনে তিনি চাষিদের তীর-ধনুক ও লাঠি চালানো শেখাতেন। এছাড়াও ইট-পাথর, মাটির ঢেলা, বেল, কাঁসা-পিতলের থালা, মাটির ও পাথরের পাত্র ছিল তাদের হাতিয়ার। দ্রুত এগোনোর জন্য বিশ্বনাথ তৈরী করেছিলেন রণপা! কখনও সেই রণপা নিয়ে বা কখনও রাতে নৌকা বেয়ে তাঁর নেতৃত্বে সেই দল একে একে নিশ্চিন্দিপুর, শান্তিপুর, চিত্রশালীর নীলকুঠীসহ বেশ কয়েকটি জমিদার বাড়ি লুঠ করে। লুঠ করা টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সামগ্রী গ্রামের গরিবদের দান করে দিতেন এই ‘বিশে ডাকাত’। নদীয়ার ইন্ডিগো কনসার্নের অত্যাচারী নীলকর স্যামুয়েল ফেডিকে অপহরণ করে তাঁর কুঠিও লুঠ করে তারা। জঙ্গলে এসে ফেডি প্রাণভিক্ষা চাইলে, দলের বিপক্ষে গিয়ে বিশ্বনাথ মুখ বন্ধ রাখা ও নীলচাষ বন্ধ করার শর্তে তাঁকে প্রাণ ভিক্ষা দেন। এটি ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল। ফেডি ছাড়া পেয়েই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে সব জানিয়ে দেয়। ব্রিটিশ সরকার ‘ব্ল্যাক ওয়ার’ নামে একটি বিশাল বাহিনী পাঠায় বিশ্বনাথকে জব্দ করার জন্য। তাঁর দল পাল্টা আক্রমণ করলে, ‘ব্ল্যাক ওয়ার’ বাহিনী প্রথমে বাঁশবেড়িয়া কুঠিতে লুকিয়ে পড়ে, পরে ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
কিন্তু নিজের করা ভুলের পরিণামেই ধরা পড়ে যান তিনি। নদীয়ার কুনিয়ার কাছে জঙ্গলে তাঁর দল যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখনই ‘ব্ল্যাক ওয়ার’ বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে। পরাজয় অনিবার্য বুঝে, বাকিদের বাঁচাতে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। এরপর বিচারের নামে চলে প্রহসন। অবশেষে ১৮০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাত্রে তাঁর ফাঁসি হয়। কিন্তু তাতেই ক্ষান্ত হয়নি সাহেবরা। এই বীর বিপ্লবীর মৃতদেহ লোহার খাঁচায় করে এনে আসাননগরে অশ্বত্থ গাছের ডালে পশু-পাখির খাদ্য হিসেবে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল, আর কেউ যেন এমন বিদ্রোহ করার সাহস না পায় – তা সুনিশ্চিত করা। তাঁর মায়ের আকুতিভরা নিবেদন স্বত্ত্বেও কঙ্কালটুকু সৎকার করতে দেয়নি তারা। আজও আসাননগরের সেই অভিশপ্ত মাঠ ‘ফাঁসি তলার মাঠ’ নামে পরিচিত।
এত কিছু করেও অবশ্য ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, বিশ্বনাথ সর্দারের যোগ্য উত্তরসূরীর মতই নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে বিদ্রোহ চালিয়ে যান নদীয়ার চাষীরা। সেই বিদ্রোহের আগুন ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলার চাষীদের মধ্যে। সেই আগুনে কবেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সাহেবদের ‘নীল’স্বপ্ন, কিন্তু বিশে ডাকাতের নাম আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল! ইতিহাস সাক্ষী, আজ প্রায় দু’শো বছর ধরে বাংলার মানুষ প্রার্থনা করে আসছে – এমন ‘ডাকাত’ যেন সকলের ঘরে ঘরে জন্মায়!
Discussion about this post