বাঙালির চিরকালীন আইডল, যাঁর নাম নারী-পুরুষ উভয়েরই মনে কম্পন তৈরি করেছে, সেই বিশাল স্টারডম, মন জয় করা হাসির অধিকারি মানুষটির আজ জন্মদিন। চিনতে পারেননি বুঝি? তিনি অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। এখনও চিনতে পারলেন না? আচ্ছা, উত্তমকুমার! এবার চিনতে ভুল হবে না একটুও। বাংলা ছবির একশ বছরের ইতিহাসে অসংখ্য ‘নায়ক’কে আমরা দেখেছি, দেখেছি তাঁদের স্টারডম। কিন্তু, উত্তমকুমার একজনই। মানুষের বিপুল ভালবাসা যেমন পেয়েছেন তিনি, নিজেও সবদিক থেকে নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন সেই ভালবাসার ঋণ শোধ করতে। তবু, তাঁর জীবনের অনেকখানি দিক আমাদের অধরাই রয়ে গেছে। হয়ত তিনি নিজেই স্বেচ্ছায় অধরা রেখেছিলেন।
উত্তমকুমার বড়ে গুলাম আলির ভক্ত ছিলেন। তিনি নিজেই বলতেন বড়ে গুলাম আলির থেকে তিনি শিখেছেন তন্ময়তা। শিখেছেন কীভাবে সর্বক্ষণ নিজেকে অনুশীলনের মধ্যে রাখতে হয়। ‘ফ্লপ মাস্টার’ থেকে চিরকালের ‘মহানায়ক’ হয়ে ওঠার পিছনেই আছে সেই অবিরত নিজের ভিতরের অনুশীলন। সেই জায়গা থেকেই সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার সময়-সুযোগ না পাওয়া নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল। কিন্তু, সেই দুঃখ তিনি নিজেই মুছে নিয়েছেন দুঃস্থ, গরীব ছাত্র ছাত্রীদের সাহায্য করে। আর্থিক সঙ্কটে পড়ে তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনি কখনও কাউকে ফিরিয়ে দেননি। এমনকি যত্ন করে সারাজীবন রক্ষা করেছেন এই সংক্রান্ত বিষয়ের গোপনীয়তা। তাঁর সাহায্য করার প্রাথমিক শর্ত নাকি ছিল যেন কোনওভাবে তাঁর বা সাহায্যপ্রার্থীর নাম প্রকাশিত না হয়।
দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিক সাহায্যের বিষয়টি সামলাতেন উত্তমকুমারের বিশ্বস্ত মানুষ সুনীল চৌধুরী৷ সাহায্যের ভঙ্গিটিও ছিল বেশ অভিনব। দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে টাকা দিয়েই উত্তমকুমার তাঁর দায়িত্ব পালন করতেন, এমন নয়। উত্তমকুমারের কাছে যেত সেইসব ছাত্র-ছাত্রীদের প্রয়োজনীয় বইয়ের তালিকা, স্কুলের হেড মাস্টারমশাইয়ের চিঠি এবং পড়াশোনা সংক্রান্ত অন্যান্য অক্ষমতার বিবরণ। এরপর উত্তমকুমার বই ও পড়াশোনার অন্যান্য খরচা দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের অভিভাবকের কাছে পাঠাতেন৷ অবশ্য এই প্রথার ব্যতিক্রমও ঘটেছে। চিঠি এবং অন্যান্য বিবরণ ছাড়া কেউ নিরুপায় হয়ে এসে তার অসহায়ত্বের কথা বললেও মহানায়কের চোখ ভিজে উঠেছে। বিনা বাক্যব্যয়ে তিনি সাহায্য করেছেন তাকে। এমন ঘটনার সাক্ষীও হয়েছিলেন সাংবাদিক রবি বসু।
উত্তমকুমার এমন এক বর্ণময়, প্রভাবশালী চরিত্র, যে সেই রঙিন ‘স্পটলাইটের’ আড়ালে মানুষটি আসলে কেমন ছিলেন, তা যেন ভাবতেই পারা যায় না। তাঁকে নিয়ে এত লেখালেখি, এত উন্মাদনা আজও সমানে হয়ে চলেছে, কারণ তিনি এখনও বাঙালির হার্টথ্রব হয়েই রয়েছেন৷ কিন্তু, অভিনয় প্রতিভা ছাড়াও, মানুষ হিসেবে মহানায়ক উত্তমকুমার যে বিরাট বড় মনের একজন মানুষ ছিলেন, তাঁর জীবনের সেই অংশ নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি বা উন্মাদনা বোধহয় আজ আমাদের চোখে পড়ে না। তাঁর জন্মদিনে তাঁর সেই বিশাল, উদার হৃদয়টিকে আমাদের শ্রদ্ধা!
Discussion about this post