কথায় বলে, সংস্কৃতই নাকি বাংলা ভাষার মা। অন্তত: একটা বড় অংশের বাঙালির ধারণা এমনটাই। এহেন ধারণার যুক্তি দর্শানো হয় এই যে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে ভারতে আগত প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার শেষ পর্বের ভাষা সংস্কৃত থেকেই প্রাকৃত ও অপভ্রংশের স্তর অতিক্রম করে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি সংস্কৃতকে বাংলা ভাষার জননী বলা যায়? এ বিষয়ে কী বলছেন ভাষাবিদরা?
ভাষাবিজ্ঞানীদের মত কিন্তু এই বিষয়ে একেবারেই উলটো। তাঁদের মতে সংস্কৃত ভাষার কোনো বিবর্তন হয়নি। সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপিকা পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, “পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণের মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষাকে কঠিন বাঁধনে আবদ্ধ করার ফলে তা মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে। তাই সংস্কৃতের কোনও বিবর্তনই সম্ভব হয়নি। একটি মৃত ভাষা কোনও ভাষারই উৎস হতে পারে না।” তাঁর কথায় ‘সেই সময়ে সাধারণ মানুষের মুখে ভাষার যে কথ্যরূপ প্রচলিত ছিল তা বিবর্তিত হয়েই মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার স্তরে প্রাকৃতের রূপ নেয়। পরবর্তীকালে সংস্কৃত নয় সেই প্রাকৃত ভাষারই বিবর্তন ঘটে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে।’
পাণিনি সংস্কৃত ভাষাকে বেঁধে দেওয়ার পর অঞ্চল ভেদে প্রাকৃত ভাষার পাঁচটি রূপ গড়ে ওঠে- মাগধী, অর্থ মাগধী, পৈশাচী, শৌরসেনী এবং মহারাষ্ট্রী। এরা প্রত্যেকেই পরিবর্তিত ও বিকৃত হয়ে পাঁচটি অপভ্রংশের রূপ নেয়। মাগধী প্রাকৃত থেকে আগত মাগধী অপভ্রংশের পূর্বী ও পশ্চিমা- এই দুটি রূপ গড়ে ওঠে। পরে পূর্বী রূপ থেকে বঙ্গ-অসমিয়া ও ওড়িয়া ভাষার জন্ম হয়। এই বঙ্গ অসমিয়া থেকেই কালক্রমে বাংলা ও অসমিয়া ভাষার জন্ম হয়।
বলাই বাহুল্য সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম এ কথা যুক্তিসঙ্গত নয়। ভাষার বিবর্তনের শেষ স্তর অপভ্রংশ। মাগধী অপভ্রংশকেই বরং বাংলা ভাষার মাতৃস্থানীয়া বলা যুক্তিযুক্ত হয়। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং সুকুমার সেন এই মতই প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার যোগ বহুদূরবর্তী। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাষায় সংস্কৃত বাংলা ভাষার মা নয়, বরং ‘অতি- অতি- অতি- অতি- অতি বৃদ্ধ পিতামহী’।
তথ্য ঋণ –
১.ভাষার ইতিবৃত্ত – সুকুমার সেন
২.দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্যা বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
৩.সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা – রামেশ্বর শ
Discussion about this post