বিশ শতকের অ্যাকাডেমিক পরিমন্ডলে কোনোদিন বিশেষভাবে চর্চিত হননি ভারতের প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী এবং পদার্থবিদ বিভা চৌধুরী। নারী বিজ্ঞানী হিসেবে পেয়েছেন বিস্ময় বা তাচ্ছিল্য। বৈজ্ঞানিক সাফল্যের পরেও কোনো পুরষ্কার বা স্বীকৃতি পাননি। বিদেশের অ্যাকাডেমিক কিছু পত্রিকা তাঁর নাম উল্লেখ করেছে বিভিন্ন সময়ে। শেষ পর্যন্ত, তাঁর মৃত্যুর তিরিশ বছর পরে তাঁকে সম্মান জানাতে প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন সেক্সট্যান্ট নক্ষত্রপুঞ্জের একটি নক্ষত্রকে ‘বিভা’ নামে নামাঙ্কিত করেছে।
বেথুন স্কুল, স্কটিশ চার্চ কলেজ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিদ্যায় এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন বিভা চৌধুরী। সেসময় পদার্থবিদ্যায় ডিগ্রিধারী একমাত্র মহিলা ছিলেন তিনি। স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পর তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ডক্টর দেবেন্দ্র মোহন বসুর সঙ্গে মহাজাগতিক রশ্মি সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেন। বিভা চৌধুরী এই সময় ফটোগ্রাফিক প্লেটের ব্যবহার করে মেসন কণা আবিষ্কার করেছিলেন। এই প্লেটের সাহাজ্যে তিনি দেখালেন মহাজাগতিক রশ্মির গতিপথ এবং কণার ভর নির্ণয় করা সম্ভব। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ম্যানচেস্টারে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটের তত্ত্বাবধানে বিভাদেবী এক্সটেনসিভ এয়ার শাওয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ‘দ্য ম্যানচেস্টার হেরাল্ড’ নামে একটি স্থানীয় পত্রিকা বিভাদেবীর গবেষণাকর্ম ও সাক্ষাৎকারকে “Meet India’s New Woman Scientist – She has an eye for cosmic rays” শিরোনামে প্রকাশ করেছিল। এছাড়া, পরবর্তীকালে বিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকাতেও তাঁর গবেষণা সংক্রান্ত লেখা ছাপা হয়েছিল।
ভারতে ফিরে বিভাদেবী হোমী জাহাঙ্গীর ভাবার টাটা ইন্সটিটিউটে যোগদান করেন। বিভাদেবীই ছিলেন টাটা ইন্সটিটিউটের প্রথম মহিলা গবেষক। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে টাটা আমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতেও গবেষণা করেন বিভা চৌধুরী। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে কোলার গোল্ড ফিল্ডস গবেষণার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।ষাটের দশকে কেজিএফ প্রজেক্টে তাঁর অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পদে পদে বাধা পেতে পেতে ক্লান্ত বিভাদেবী স্বেচ্ছাবসরের পরেও গবেষণা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের পরিচালক প্রফেসর ডি.এন.কুন্ডু অতিথি কর্মী হিসেবে বিভাদেবীকে গবেষণার সুযোগে সাহায্য করেন।
বিভা চৌধুরীর ফোটোগ্রাফিক প্লেটের পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষণা চালিয়ে ১৯৫০ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান পাওয়েল ফুলটোন। আজও অনেকে মনে করেন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল বিভাদেবীর। তার বদলে সারা জীবন আড়ালে কাটিয়েছেন তিনি। তবে নিজের কাজ করে গেছেন অশ্রান্তভাবে। ১৯৯১ সালে মারা যাওয়ার আগেও তাঁর লেখা ‘নেচার’ পত্রিকায় ছাপা হয়।বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে গেছেন নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে। আজও তাই পৃথিবী থেকে ৩৪০ আলোকবর্ষ দূরে আলো দিচ্ছে ‘বিভা’ নক্ষত্রের বিভা।
Discussion about this post