গ্রাম বাংলার লোক সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত আচার-অনুষ্ঠান বা প্রথা বঙ্গদেশে ‘লোকাচার’ নামে পরিচিত। যুগের পর যুগ বদলায় – কিন্তু একটি অঞ্চলের সঙ্গীত, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, প্রকৃতি, ধর্ম বিশ্বাস, সামাজিক বিধি, পেশাগত বিষয় সব কিছুর প্রামাণ্য দলিল হিসেবে থেকে যায় সেই অঞ্চলের লোকাচারই। জানলে অবাক হবেন – আপাত দৃষ্টিতে শুধুমাত্র একটি রীতি মনে হলেও, এই লোকাচারগুলির নেপথ্যে রয়েছে কিন্তু সেই বিজ্ঞান! রাঢ়বঙ্গের এমনই এক বিশেষ প্রাচীন লোকাচার হল ‘নল সংক্রান্তি’ বা ‘ডাক সংক্রান্তি’।
মূলত: কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত এই লোকাচারটি পালিত হয় আশ্বিন মাসের শেষদিন, অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন৷ এই সময়টি হল ধানগাছে ফসল আসার সময়। তাই ধান গাছকে গর্ভবতী মহিলার সঙ্গে তুলনা করা হয়৷ ধানের ভেতরের অংশটি এই সময়ে থাকে একেবারে দুধের মতো। এটিই পরবর্তী পর্যায়ে চালে পরিণত হয়। এই নরম মিষ্টি দুধের ন্যায় অংশটি পোকামাকড়ের খুব প্রিয়। ফলে এই সময় ধানের ওপর পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। তারা ধানের দুধর মতো অংশটি শুষে নেয়। ফলে ধানের পুষ্টি হয় না। সেই ধান থেকে আর চালও পাওয়া যায় না। এই সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচতে কৃষকরা এক অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করা শুরু করেন। কৃষকদের মতে, এই পদ্ধতি আসলে ধান গাছের সাধভক্ষণ অনুষ্ঠান, ‘নল সংক্রান্তি’! পরবর্তীতে যা একটি লোকাচার হিসেবে প্রচলিত হয়!
এই নল সংক্রান্তির দিন, অর্থাৎ আশ্বিন মাসের শেষদিনের আগের দিন কেটে আনা হয় নল গাছ। এরপর নিম, কালমেঘ, তুলসী সহ দশ বার রকমের ভেষজ খুব ছোটো ছোটো করে কুচি করা হয়। শেষে তার সাথে মেশানো হয় আতপ চাল ও শুকনো চিংড়ি মাছ। তারপর ঐ মিশ্রণটিকে বড় পাতায় মুড়ে নলগাছে বাঁধা হয় পাট দিয়ে। যিনি বাঁধেন, তিনি বাঁধার সময় কথা বলা থেকে বিরত থাকেন। সারারাত জেগে চলে এই নল বাঁধার কাজ। সংক্রান্তির দিন ভোরে সূর্যের আলো ফোটার আগেই এই মিশ্রণ বাঁধা নলটি ধানজমিতে ঈশান কোণে পুঁতে দেওয়া হয়। সঙ্গে বলা হয় – “নল পড়ল ভুঁয়ে/ যা শনি তুই উত্তর মুয়ে।” এখানে শনি বলতে পোকামাকড়কেই বোঝানো হয়েছে! পাশাপাশি, দুই মেদিনীপুর জেলায় এই দিন সকালে প্রতিটি বাড়িতে নিমপাতা, হলুদ আর আতপ চালের বাটা বা আলই খাওয়ার প্রথাও চালু রয়েছে। খাওয়ানো হয় বাড়ির গরুকেও। বিশ্বাস করা হয়, এতে শরীরের যাবতীয় রোগ-জ্বালা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়!
তবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে বোঝা যায়, গ্রামবাংলার এই অভিনব প্রথাটি আসলেই কতখানি বুদ্ধিদীপ্ত! ফসল বাঁচানোর জন্য এই প্রথাটির যখন প্রচলন হয়, তখন বাজারে আজকের মতো এত কীটনাশক বা রাসায়নিক সারের আবির্ভাব ঘটেনি। কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করার জন্য এই যে মিশ্রণটি তৈরি করা হয়, এটিতে থাকে তীব্র ঝাঁঝালো একটি গন্ধ। ফলে পোকামাকড়রা ফসলের থেকে দূরেই থাকে! শুধু তা-ই নয়, জমির মাঝে পুঁতে রাখা নলগাছে পেঁচা জাতীয় প্রাণীরা এসে খুব সহজেই ফসলের জন্য ক্ষতিকারক প্রাণীগুলিকে শিকার করে৷ সবদিক থেকেই রক্ষা পায় কৃষকের সম্পদ৷ তবে দুঃখের বিষয়, সভ্যতার অগ্রগতির চাকায় পিষে আজ ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে পল্লীবাংলার ঐতিহ্য এই লোকাচারগুলি!
চিত্র ঋণ – ভাস্করব্রত পতি, তথ্য ঋণ – অপূর্ব কুমার জানা
Discussion about this post