আজ বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে উদযাপিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষ। ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পদার্পণ হলো সূর্যোদয়ের সঙ্গে। ইষ্ট দেবতার কাছে দোয়া-প্রার্থনা সহ আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে দিনটিকে স্মরণীয় করতে বাঙালি আজ ব্যস্ত দিনের শুরু থেকেই। হিন্দু ব্যবসায়ীদের আজ হালখাতা। মন্দিরে মন্দিরে চলবে প্রার্থনা, মঙ্গলকামনা। তবে পয়লা বৈশাখের পার্বণ ধর্মীয় আচারের সঙ্গে যুক্ত করাটা ইতিহাস বিমুখতা হবে। ইসলামী হিজরি সনের সঙ্গে বাংলার পঞ্জিকার এগারো দিনের তফাতের জন্য রাজস্ব, খাজনা ইত্যাদির উসুলির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছিল গোলযোগ। তাই পয়লা বৈশাখকে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনকাল থেকে রাজস্ব, খাজনা ইত্যাদি মিটিয়ে দেওয়ার নির্দিষ্ট তারিখ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। সেই সূত্র ধরে বৈশাখের পয়লা তারিখ বাংলা ও বাঙালির জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
তবে বাংলা নববর্ষ বাঙালির নয়া পঞ্জিকা ধরে উৎসবের পরিসরে শুধু সীমিত হয়ে থাকেনি। পয়লা বৈশাখ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীকও হয়েছিল। বাঙালির আত্মমর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে এই উৎসবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ব্রিটিশ সরকারের কুখ্যাত তলোয়ার খন্ডিত করে ভারতকে। রক্তাক্ত ভারতের পাঞ্জাব ও বাংলার ইতিহাস সবারই জানা। রাতারাতি বাংলা দ্বি-খণ্ডিত হয়। সৃষ্টি হয় পূর্ব পাকিস্তানের। পাল্টে যেতে থাকে দ্রুত গতিতে বাঙালির ইতিহাস। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মূলে চলতে থাকে নিষ্ঠুর কুঠারাঘাত। উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে ঝাঁঝরা হতে থাকে বাঙালির সাংস্কৃতিক সম্পদ। চুপ থাকেনি সবুজ শ্যামল বঙ্গভূমির বীর বাঙালি। আপন কৃষ্টি ও সৃষ্টি বাঁচাতে এগিয়ে আসে একাধিক সংগঠন। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে ‘ছায়ানট’।
বাঙালিয়ানার রক্ষার্থে সম্মুখ সমরে ছায়ানটের ভূমিকা স্বাধীন বাংলাদেশ এক বাক্যে মেনে নিতে অস্বীকার করে না। বিংশ শতকের ষাটের দশকে রমনার বিখ্যাত বটবৃক্ষ প্রতীক হয়ে ওঠে বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল জাতীয়তাবাদের। শত সহস্র বাঙালি বাংলা নববর্ষকে ঘিরে ছায়ানটের উদ্যোগে সূর্যোদয়ের সঙ্গে মেতে উঠেছিলেন গানে ও কবিতায়। আকাশে বাতাসে মুখরিত হয়েছিল রবীন্দ্র-নজরুল। নববর্ষ নয়া উন্মেষের বার্তা সঞ্চারিত করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে নিপিড়িত আপোষহীন বাঙালির মনে। নতুন ভোরের স্বপ্ন এঁকেছিল বাঙালির হৃদয়ে। ছায়ানটের সৃষ্ট বিপুল আলোড়ন একত্রিত করতে পেরেছিল নববর্ষকে ঘিরে বাংলার সব স্তরের মানুষদের।
বাঙালির উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছিল দেখার মতো। বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার তাগিদে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ফরমান জারি করে নিষিদ্ধ করে দেয় রবীন্দ্রনাথকে। ‘হিন্দু-বাঙালি’ রবি ঠাকুরকে ইসলাম বিরোধী ঘোষণা করতে গর্জে উঠেছিল বাংলা। ছায়ানট সংগঠনকে আরও মজবুত করে বাঙালির স্বাধীনতা, সার্বভৌমিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আকাঙ্খায় মুক্তিযুদ্ধের সংকল্পকে প্রতিষ্ঠানের আত্মার সঙ্গে বেঁধে নেয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে বাংলা নববর্ষ তাই শুধু হালখাতা বা উপাসনায় সীমিত থাকেনি, জাতির প্রত্যয় ও সংস্কৃতিকে ঘিরে আমরণ সংগ্রামের বিজয় তিলক রূপে অমর-উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়।
Discussion about this post