পৃথিবী বদলাচ্ছে, সমাজ বদলাচ্ছে। নারী পুরুষের বৈষম্য কমছে আস্তে আস্তে। তবু, কতটা বদল হলে তবেই তাকে বদল বলা যাবে, সেটা এখনো আমাদের অজানা। কারণ, এখনও দৈনন্দিনের কাজেকর্মে তো বটেই, জনপ্রিয় মাধ্যমেও নারীকে পণ্য ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনা মানুষ। অন্তত মানুষকে অন্যকিছু ভাবতে দেওয়া হয়না। সম্প্রতি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পেলো ভারত। ভারতীয় ক্রিকেট দল নিয়ে বাংলা এবং সারা দেশের মানুষের গর্বের শেষ নেই। পুরুষ ক্রিকেটাররা একেকজন আইডল। তাঁদের হালহকিকত সকলের ঠোঁটস্থ। কারণ, তাতেই দেশের ‘লাভ’। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, বলুনতো কে লোপামুদ্রা ভট্টাচার্য, কিংবা সন্ধ্যা মজুমদার?
ক্রিকেট ছিল একসময় মূলত ছিল পুরুষের দখলে। এখনও কথায় কথায় বলে থাকেন মানুষ, ক্রিকেট হল ‘জেন্টেলম্যানস্ গেম’। তবুও, কয়েকজন সেই জেন্টেলম্যানদের পেরিয়ে, চিরাচরিত সংকীর্ণতা উপেক্ষা করে, ক্রিকেট মাঠে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিলেন। খেলেছিলেন দেশের হয়ে। সে আজকের কথাও নয়। আজ এমন ঘটলে তা ততখানি অবাক করা হবে না। কারণ, ওইযে, সমাজ বদলাচ্ছে। কিন্তু সেই সময় এসব অকল্পনীয় ছিল। কারণ, জেন্টেলম্যানদের পেরিয়ে মাঠে জায়গা করে নিচ্ছিলেন ‘জেন্টেলউইমেন’রা! ব্যাট বল হাতে মাঠে নেমেছিলেন লোপামুদ্রা, রুনা, গার্গী, সন্ধ্যারা। বাংলার মেয়েরা!
আজ ঝুলন গোস্বামীর সাফল্য বাংলার মেয়েদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাঁর আগে পাইওনিয়ার হয়ে এসেছিলেন লোপামুদ্রা ভট্টাচার্য। মিডিয়াম পেস বোলার, ভারতের জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। একটি টেস্ট ম্যাচ এবং ১৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। পরে জাতীয় নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করেছেন। রুনা বসু ছিলেন একজন ডানহাতি ব্যাটার এবং মিডিয়াম পেস বোলার। ভারতের জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের হয়ে ৬টি টেস্ট ম্যাচ এবং একটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। তিনি বাংলার প্রতিনিধিত্বও করেছেন ভারতের ঘরোয়া লিগে। সন্ধ্যা মজুমদার দিয়েছিলেন তাঁর দক্ষ ব্যাটিং ও তীক্ষ্ণ ক্রিকেটীয় বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং ভারতীয় ক্রিকেট দলেও খেলেছেন। ছিলেন গার্গী ব্যানার্জি এবং শর্মিলা চক্রবর্তীও।
১৯৭৩ সালে হয়েছিল প্রথম মহিলা বিশ্বকাপ। ভারতের জাতীয় মহিলাদল সুযোগ পেয়েছিল ১৯৭৮ সালে। সে দলে ছিলেন এই পাঁচ বাঙালি নারী। সাতের দশকে ক্রীড়া সাংবাদিকতা আজকের মত ছিল না। মাঠে মেয়েদের খেলা দেখার ‘Hype’-ও সেই অর্থে ছিল না। যারা যেত, তাদের বেশিরভাগই শার্ট প্যান্ট পরা মেয়েদের দেখতে যেত, যেন সে এক অত্যাশ্চর্য কান্ড। আজও সংবাদমাধ্যমে, বিনোদনে, খেলার জগতে মেয়েদের শরীরকে বাদ দিয়ে মেধা, পরিশ্রম, ধৈর্যকে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবু, মেয়েরা এগোচ্ছেন। অধিকার এবং সম্মান তাঁরা আদায় করে নিতে পারেন। যেভাবে পেরেছিলেন এই পাঁচ বাঙালি মেয়ে। ‘ভদ্দরলোকে’দের খেলায় তাঁরা নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন নিজেদের, এই দুরন্ত ‘ভদ্রমহিলা’দের আমরা যেন ভুলে না যাই!
Discussion about this post