১৯৯২ সাল। দেশজুড়ে এক অস্থির সময়। বাবরি মসজিদের ঘটনা নিয়ে উত্তাল সারা দেশ। ঠিক সেই সময়েই দক্ষিণ কলকাতার ঠাকুরপুকুর অঞ্চলে শেখ আব্দুল হান্নান খুললেন একটি ছোট্ট বেকারি— নাম দিলেন “কারকো বেকারি”। বড়দিনের উৎসবের রঙিন মেজাজে তিনি এলাকাবাসীর মনে একটু উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে চাইলেন। আর সেখান থেকেই শুরু হলো এক ঐতিহ্যের যাত্রা, যা আজও অব্যাহত।
বাকি বেকারিগুলোর গল্প আলাদা। তারা সারাবছর কেক বিক্রি করে। কিন্তু কারকো? এখানকার ওভেন জ্বলে মাত্র ৭-৮ দিনের জন্য— ডিসেম্বরের ১৫-১৬ তারিখ থেকে বড়দিনের আগের দিন, ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই কয়েকদিনেই যেন গোটা এলাকার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষজনের জন্য উৎসবের আবহ তৈরি হয়। এখানে কেউ এসে নিজের পছন্দের রেসিপি মতো কেক বানান, কেউ আবার শুধুই গন্ধ শুঁকে বা উনুনের আঁচ দেখে মন ভরান। কারকো বেকারি যেন শুধুমাত্র বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়— বরং মিশে গেছে এলাকার সংস্কৃতি আর আবেগের সঙ্গে।
ইলেকট্রিক ওভেনের যুগে দাঁড়িয়েও কারকো বেকারির বিশেষত্ব তার কাঠের উনুন। ১৯৯২ সালে যে ঐতিহ্যের সূচনা হয়েছিল, ২০২৪ সালেও তা একইরকমভাবে ধরে রাখা হয়েছে। শেখ আব্দুল হান্নান বললেন, “এটা তো শুধু ব্যবসা নয়। এটা একপ্রকার ভালোবাসা। আমাদের এলাকায় বড়দিন যেন একটু বেশিই মিষ্টি হয়, সেটাই আমার চেষ্টা।” আগে এই বেকারী সারা বছর কেক বেক করত, কিন্তু এখন সারাবছর বন্ধই থাকে এই বেকারী। শুধু বড়দিনের ৭ থেকে ৮ দিন আগে মাত্র ২০ জন শ্রমিক নিয়ে আব্দুল হান্নান ও সালাউদ্দিন মল্লিক এই বেকারীর দরজা খোলেন।
আব্দুল হান্নান বলেন, “এখন আর কোনো দোকান বা কোনো বেকারীতেই ভালো জিনিস পাওয়া যায়না। সব জায়গার কেক একইরকম খেতে। সব জায়গায় কেক একই উপকরণ দিয়ে তৈরি। কোথাও খাঁটি ঘি বা মাখন নেই। হয়তো মেশিনে তৈরি কেক তাড়াতাড়ি তৈরি হয়, কিন্তু আমরা হাতে যেটা বুঝতে পারি, সেটা কি মেশিন বোঝে? তাই এখনো এই এলাকায় মানুষ প্রতি বছর বড়দিনের সময় আসেন এই বেকারীতে। বেক করেন নিজের পছন্দের কেক একেবারে নিজের মনের মত করে। ফলে এই কেকের মান ভালো না হয়ে যায় কোথায়।”
কারকো বেকারির দরজা কেবল পণ্য বিক্রির জন্য খোলে না। এটি খোলে আত্মার টানে, সংস্কৃতির ভালবাসায়। ঠাকুরপুকুর, টালিগঞ্জ, বেহালা— আশপাশের অঞ্চলের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে শেখ আব্দুল হান্নানের এই ছোট্ট প্রচেষ্টা আজ পরিণত হয়েছে এক বড় ঐতিহ্যে। বড়দিনের আগে ঠাকুরপুকুর অঞ্চলে গেলে হয়তো দূর থেকেই ভেসে আসবে কাঠ পোড়ার গন্ধ। সেটাই কারকো বেকারির ঐতিহ্যের নিদর্শন। আধুনিক ইলেকট্রিক ওভেনের চকমকের মাঝেও শেখ আব্দুল হান্নানের কাঠের উনুনের আঁচ আজও মনে করিয়ে দেয়— ঐতিহ্য কখনও পুরনো হয় না। বরং সময়ের সঙ্গে আরও মজবুত হয়।
Discussion about this post