সেই ১৯৫০ সাল থেকে শুরু। জৌলুস কিছুটা হারালেও আজও সগৌরবে চলে আসছে। তখনকার মতই এখন নতুন প্রজন্মের তারকারাও অপেক্ষা করে থাকেন এই একটি দিনের জন্য। বসুশ্রী সিনেমা হলে পয়লা বৈশাখের জলসা! হলের সর্বেসর্বা মন্টু বসুর তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছিল এই জলসা। তবে ৬ ফুট ২ ইঞ্চির সেই মানুষটি না থাকলে হয়ত আজ এই জলসার জৌলুসের ছিঁটেফোঁটা হদিসও পেত না সারা কলকাতা। সেই মানুষটি- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যার হাত ধরেই প্রথম বাংলায় নতুন বছর শুরুর দিন বসুশ্রীতে শুরু হয় ‘নববর্ষের জলসা’।
কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোডে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ধাঁচে তৈরি বসুশ্রী হলটি। প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যেতে কলকাতার বিখ্যাত সব তারকারা আড্ডা জমাতেন সেখানে। সেই আড্ডাতে হলের প্রাণ-কর্তা মন্টু বসু, শ্যামল মিত্র, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অজিত চট্টোপাধ্যায় হাজির থাকতেন রোজই। তবে আড্ডার প্রাণপুরুষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় না থাকলে আড্ডাটাই যেন প্রাণহীন হয়ে পড়ত। এইরকমই এক আড্ডায় পয়লা বৈশাখের ক’দিন আগে, হেমন্তবাবু প্রস্তাব দিলেন পয়লা বৈশাখের দিন একটা জমজমাট জলসা করলে কেমন হয়! প্রস্তাব শুনে সবাই তো দারুণ খুশি! সাদরে সম্মতিও জানালেন। কিন্তু তখনও এ দেশে জলসার ব্যাপারে তেমন কেউই বিশেষ জানতেন না। তবে হেমন্তবাবুর এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন মন্টু বসু৷ ব্যাস! আর কী! সে বছর থেকেই বসুশ্রীতে শুরু হল বছর শুরুর জলসার সফর।
প্রথম বছর থেকেই এই দিনটার জন্য বহু মানুষ অপেক্ষা করে থাকতেন। জলসার আগের দিন বাংলার বাইরের ভিন্ন রাজ্য থেকেও লোকজন এসে সামনের ফুটপাথে অপেক্ষা করতেন। টিকিটের কোনও ব্যাপার ছিল না তাই জলসা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই হাউসফুল হয়ে যেত বসুশ্রী। তখনকার সময়ের বিচারে এই জলসা ছিল একদম পয়লা নম্বরে। কত যে তাবড় তাবড় শিল্পীদের দেখা মিলত তার ইয়ত্তা নেই। এই অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়ে তাঁরাও নিজেদের ধন্য মনে করতেন। সে সময় গ্রিনরুমের ব্যবস্থা ছিল না। শিল্পীরা সামনের সারিতেই বসতেন এবং ডাক পড়লে স্টেজে উঠতেন। শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন এই জলসার অতি পরিচিত কিছু মুখ। লতা মঙ্গেশকর এবং মহানায়িকা সুচিত্রা সেনও এই অনুষ্ঠানে একবারের জন্যই এসেছিলেন বসুশ্রীতে। কলকাতায় থাকলে আসতেন কিশোর কুমারও। সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো ছিলেনই।
সেবছর মহানায়ক উত্তম কুমার আসবেন জলসাতে। খবরও খুব ছড়িয়েছে চার দিকে। মহানায়ককে দেখার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে ভিড়ের চাপে চোটও পেয়েছিলেন বেশ কিছু মানুষ। সেবার বাংলা বছরের প্রথম দিনে সেই শত শত মানুষের ভিড়ে গোটা এলাকাই প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়! তারপর থেকে উত্তমকুমার আসার আগে কোনও ঘোষণাই করা হত না। জলসার দিন হলের সামনের গেট দিয়ে না ঢুকিয়ে অত্যন্ত গোপনে হলের পিছনের গেট দিয়ে আনা হত মহানায়ককে৷ তবে নায়ককে দেখতে তো চান সব্বাই! এদিকে হাজার হাজার লোক তো ভেতরে ঢুকতে পারবেন না! শেষমেশ একটা উপায় বের করা হল। হলের সামনে রাস্তায় উপর সামিয়ানা টাঙিয়ে লাগানো হল বেশ কতগুলো মাইক৷ সেই মাইকেই মহানায়কের গলা ভেসে আসতে লাগল। ব্যাস! খুশি মনে অনুষ্ঠান শুনলেন মানুষজন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মারা যাওয়ার পর বেশ কিছু বছরের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পয়লা বৈশাখের এই জলসা৷ বসুশ্রীর মন্টু বসু হেমন্ত বাবুকে ছাড়া এই অনুষ্ঠান চালিয়ে যেতে রাজি ছিলেন না। ফলে বন্ধ হয়ে গেল জলসা। বসুশ্রীতে জলসা নেই এটা ভেবেই পয়লা বৈশাখের এই দিনটায় ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেত মন্টুবাবুর। তাঁর কষ্ট দেখে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আবার জলসা চালু করার জোরাজুরি শুরু করলেন। অজয় বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে ফের শুরু হল বসুশ্রীর জলসা তবে সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে আগের জৌলুস হারিয়ে কিছুটা যেন ফিকেই হয়ে পড়েছে বসুশ্রীর এই পয়লা বৈশাখের জলসা। তবে এখনকার নতুন প্রজন্ম এখনও এই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য সারা বছর ধরেই মুখিয়ে হয়ে থাকেন। আর স্বর্ণযুগের সেই সব বিখ্যাত শিল্পীরা এখনও এই অনুষ্ঠান নিয়ে নস্ট্যালজিয়ায় ভোগেন৷ সেই সোনালী দিনগুলো তাদের স্মৃতির চিলেকোঠায় আজও অমলিন হয়ে রয়েছে।
Discussion about this post