চারদিক ঘেরা পাহাড়ে। তার গায়ে কত অজস্র পাহাড়ি গাছ তাতে ফুটে রয়েছে নাম না জানা কতশত পাহাড়ি ফুল। তার মধ্যে দিয়ে রয়েছে এক টানেল। টানেলের ভিতর দিয়ে পাতা রেললাইন। ছুটে চলেছে ট্রেন তার গন্তব্যের দিকে। ঠিক ছবির মতো কোনও দৃশ্য তাই না? এটি ভারতের হিমাচল প্রদেশের অন্যতম বিখ্যাত এক রেলওয়ে, কালকা-সিমলা রেলওয়ে।
ঠিক তখনই চোখে আসে এর বিপরীত এক দৃশ্য! গা ছমছমে টানেল। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয় সেখানে। ক্ষণে ক্ষণে পা পিছলে যায় শ্যাওলায়। ওপর থেকে টপটপ করে জল পড়ে চলেছে। সঙ্গে এক বোটকা গন্ধও নাকে আসতে পারে। এক নিমেষেই কিছুক্ষণ আগের সেই মনোরম দৃশ্য বদলে গেল গা ছমছমে কোনও সিনেমার প্লটে! অথচ এককালে সেই টানেল ছিল কিছুক্ষণ আগের দেখা রেলওয়েরই এক অংশ। এটি হল ৩৩ নং বারোগ টানেল। টানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ১.১৪ কিমি। কালকা-সিমলার সবচেয়ে লম্বা টানেল এটিই। এমনকি বিশ্বের সবথেকে সোজা টানেলও এই বারোগ টানেলই।
কিন্তু বর্তমানে স্থানীয়দের কাছে এটি পরিচিত ভূতুড়ে টানেল হিসাবেই। কেন? ঠিক কোন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে এই টানেল? জানতে গেলে নজর ফেরাতে হয় অতীতে। হিমাচলের সোলান গ্রামের নাম পাল্টে বারোগ সাহেবের নামে বারোগ বলেই বিখ্যাত হয়। কে এই বারোগ সাহেব? সিমলা কালকা রেলওয়ে তৈরী করার ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার তিনি। যার হাতেই গড়ে উঠেছিল এই টানেল।
১৯০০ থেকে ১৯০৩ সাল। কর্নেল বারোগ প্রায় ৫০১৩ ফিট ওপরে সোলানে খুঁড়ছেন টানেল। কিন্তু সে কাজ করতে গিয়েই ছোট্ট একটা ভুল করে ফেললেন তিনি। পরবর্তীতে যে ভুলই বাধা হয়ে দাঁড়াল তাঁর কাজে। কর্মীদের দুভাগে পাহাড়ের দুদিক থেকে পাথর কাটতে বললেন তিনি। কিন্তু অঙ্কে ভুল হয়ে গেল। দুদিক থেকে কাটা সুড়ঙ্গ একসঙ্গে মিশে গিয়ে এক টানেল হল না। যা দেখে ব্রিটিশ সরকার রেগে একটাকা জরিমানা ও সাসপেন্ড করল বারোগ সাহেবকে। অপমানে, বিষাদে, গ্লানিতে একরাতে নিজের কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে আধা সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকলেন তিনি। তারপর গুলি করে নিজেকে শেষ করে দিলেন।
ঠিক এরপরই দৃশ্যে প্রবেশ ‘ভালকুবাবা’র। তিনি রহস্যময় সাধুবাবা। স্রেফ লাঠি দিয়ে মেপে মেপেই জুড়ে দিলেন পৃথিবীর একমাত্র সোজা টানেল। টয় ট্রেনে চেপে যা পেরোতে সময় লাগে মাত্র আড়াই মিনিট! তবে তাঁর সেই কীর্তি আড়ালেই রয়ে গেল। তবে সিমলার পুরনো বাসস্ট্যান্ডের কাছে এখনও রয়েছে ভালকুবাবার মিউজিয়াম। সেখানে গেলে তাঁর সম্পর্কে জানা যায় বেশ কিছু অজানা তথ্য।
তবে ভালকুবাবা যাই করুন। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে কিন্তু বারোগ টানেল রয়ে গেছে এক ভূতুড়ে টানেল হিসাবেই। মাঝ রাতে অনেকেই নাকি দেখেছেন সাদা সাহেবের আত্মা আজও ঘুরে বেড়াচ্ছেন সেই তেত্রিশ নম্বর টানেলে। তার সত্যতা যাচাই করবে কে? তবে আজও সেই টানেলের মধ্য দিয়ে ট্রেন ছুটে গেলে কিছুটা গা ছমছম করে বৈকি। প্রাচীন লোককথা ভূতুড়ে সাহেব যে আজও মিশে আছেন বারোগ টানেলের প্রতিটি ইট, বালি, ধূলিকণায়…
সংঘমিত্রা বনবিবির ভ্রমণকাহিনী , সম্পাদনা করেছেন মৌসুমী মোদক, ছবি তুলেছেন সংঘমিত্রা বনবিবি
Discussion about this post