ভোর থেকেই জমিদার বাড়ির সামনে শুরু হত প্রজাদের জমায়েত, হাঁকডাক। কখন জমিদার বাবু আসবেন? অন্দরমহলে পাইক, পেয়াদা, বরকন্দাজের ব্যস্ততা কোনও কিছুরই কমতি ছিল না এই জমিদার বাড়ীতে। পূজা-পার্বণ থেকে সকল উৎসব আয়োজনে আমন্ত্রিত হতেন কলকাতা থেকে শুরু করে সমগ্র বাংলার নামজাদা সহ ব্যক্তিবর্গই। কিন্তু বর্তমানে সেসব যেন রূপকথার কল্প-কাহিনীর মতোই শোনায়। ঝোপঝাড় আর লতাপাতায় ঘিরে রয়েছে পুরো বাড়ি। কেমন যেন একটা গা ছমছমে শুনশান নীরবতায় ঘেরা। ইঁট, সুরকি, পোড়া মাটির কারুকার্য এবং তৎকালীন আভিজাত্যে পরিপূর্ণ কয়েক বিঘা জায়গা জুড়ে থাকা এই জমিদার বাড়ি আজ পরিত্যক্ত। দিনের আলোতেও কেউ ঢোকার সাহস করে না এখানে। নিশুতি রাতে ভেসে আসে হুতুম পেঁচা’র ডাক আর শেয়ালের আর্তনাদ। অযত্ন আর অবহেলায় কালের সাক্ষী হয়ে আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে! পূর্ববঙ্গের বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার জমিদার জানকী বল্লভ রায় চৌধুরীর জমিদার বাড়ি, ‘কলসকাঠী’।
প্রায় তিনশ বছর আগে সতেরোশ শতকের শেষের দিকে জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী ‘কলসকাঠী’ জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন গারড়িয়ার জমিদার রামাকান্তের পুত্র। জমিদার রামাকান্ত রায়ের দু’জন পুত্র। বড় পুত্র রাম বল্লভ রায় চৌধুরী এবং ছোট জন জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী। জমিদারীর কাজে উদাসীন থাকায় রামাকান্ত রায় বড় পুত্রকে বাদ দিয়ে ছোট পুত্র জানকী বল্লভ রায় চৌধুরীর হাতে দায়িত্ব তুলে দেন। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে রাম বল্লভ রায় ছোট ভাই জানকী বল্লভ রায়কে হত্যার পরিকল্পনা করেন। মূলত জমিদারী পাওয়ার জন্যই এই হত্যার পরিকল্পনা করেন রাম বল্লভ। জানকী বল্লভ তাঁর বৌদির মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্রের জানতে পারেন। রাতের আঁধারেই তিনি মুর্শিদাবাদে পালিয়ে যান এবং সেখানে নবাবের কাছে আশ্রয় নেন। মুর্শিদাবাদের নবাব তখন তাঁকে রংপুর পরগনার জমিদার হিসেবে নিযুক্ত করেন। জমিদারি পেয়ে তিনি কলসকাঠীতে এসে বসতি স্থাপন করেন। তারপরই প্রতিষ্ঠিত হয় এই জমিদার বাড়ি। এখানে বংশপরম্পরায় একাধিক জমিদারের বাস ছিল। তাঁদের আলাদা আলাদা জমিদার বাড়িও ছিল। মূলতঃ এই জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তনকারী জানকী বল্লভ রায় চৌধুরীরই বংশধর ছিলেন তাঁরা।
কলসকাঠীকে শুধু জমিদার বাড়ি না বলে বলা যায় একটি প্রাচীন শহর। জমিদারবাড়ির পাশেই অবস্থিত শিব মন্দির। প্রায় শত বছরের পুরনো এই মন্দিরটি কষ্টি পাথরের মূর্তি ও অন্যান্য ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ। এই মন্দিরে এখনও মূল্যবান কষ্ঠিপাথরের মূর্তি রয়েছে। চুরির ভয়ে মন্দিরের ভেতরে দেবীর মূর্তিকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। মন্দিরের সামনে ছোট একটি বেদী। যেখানে পূজার সময় প্রাণী বলি দেয়া হয়। প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এখানে উদযাপিত হয় ঐতিহাসিক জগদ্ধাত্রী পূজা। সর্ববৃহৎ দূর্গা পূজায় কলসকাঠীতে তেমন আনন্দ-উৎসব না হলেও, এ পূজা ঘিরে কলসকাঠী পরিণত হয় লাখো মানুষের মিলন মেলায়। দূর দুরান্তের গ্রাম-গঞ্জ থেকে এই পূজায় অংশ নিতে ছুটে আসে মানুষজন।
তবে আক্ষেপের বিষয় হলো প্রায় তিনশো বছরের পুরনো সেই বাড়ি অবহেলা ও সংরক্ষণের অভাবে আজ ধ্বংসপ্রায়। কলসকাঠীর জমিদারদের মধ্যে সর্বশেষ জমিদার ছিলেন রাজেস্বর রায় চৌধুরী। ‘৪৭-এর দেশভাগের পর সবাইকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। ফলে এখন সে বাড়িকে দেখাশোনা করারও প্রায় কেউই নেই। জমিদার বাড়ির প্রাচীর ও ছাদ সবই আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে। এখানের মন্দির গুলিও প্রায় সবই ধ্বংসের মুখে। উত্তরসূরীর অভাবে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে আজ ধুঁকছে কলসকাঠীর বাড়ি। এ লড়াই যে কতদিন জারি থাকবে তা বলা খুবই কঠিন। জমিদার বাড়ির প্রতিটি ইঁট আজও খুঁজে বেড়ায় তাঁর আগামী উত্তরসূরী। যে তাকে যত্নে, আদরে আবার গড়ে তুলবে। কিন্তু মেলে না তার কোনও সন্ধান৷ এ বাড়ির আগামী ভবিষ্যৎ কী তা আজ আর কেই বা বলতে পারে!
Discussion about this post