প্রাচীনকালের আর্য সমাজ ব্যবস্থায় নারীর আসন ছিল সমাজে সবথেকে উপরে। সে যুগে, গার্গী, মৈত্রেয়ী, খনা, অপালার মতো বিদুষী নারীরা নিজেদের শিক্ষার জোরে সমাজে পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার অধিকার এবং সম্ভ্রম আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। তবে পরবর্তীতে, বিশেষত মধ্যযুগে পুরুষতন্ত্রের দাপটে মহিলারা কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন সমাজে। কিন্তু, পরিস্থিতি পাল্টায় ভারতীয় সমাজে আধুনিকতা প্রবেশের সাথে সাথে। আধুনিক ভারতে, মহিলাদের সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য একটা লড়াই শুরু করেছিলেন পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণদেব। ১২৮০ বঙ্গাব্দের ১৩ জ্যৈষ্ঠ ফলহারিনী কালিকা পুজোর দিন শ্রীমা সারদাদেবীকে দেবী জ্ঞানে পুজো করেছিলেন রামকৃষ্ণদেব। এ সমাজে নারীর স্থান ঠিক কোথায়, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ।
রামকৃষ্ণদেবের শ্রীমাকে পুজো করার মতো এক কালীপুজো কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখনো হয়ে আসছে। মা কালীর কোন চিন্ময়ী রূপের পুজো না করে, এক জীবন্ত নারীকে পুজো করা হয় বাঁকুড়া জেলার ইন্দাসের মির্জাপুরের সাঁতরা বাড়িতে। বছরের পর বছর ধরে এই বাড়ির বড় বৌমাকে মা কালীর বেশে পুজো করা হচ্ছে। তাই স্বভাবতই, প্রতিবছর মা কালীর এই মানবী রূপ দেখার জন্য মানুষের ঢল নামে এই বাড়িতে।
সাঁতরা পরিবার জানিয়েছে, এই বাড়িতে কালীপুজো বহু যুগ পুরোনো। আগে মাটির মূর্তিতেই পুজো করা হতো। তবে, একবার সেই পরিবারের কোন এক পূর্বপুরুষ মাটির মূর্তিপুজো বন্ধ করার স্বপ্নাদেশ পান। পরিবর্তে, সোনা বা অষ্টধাতুর কোন মূর্তি পুজো করার নির্দেশ পেয়েছিলেন তিনি। আর্থিক সংকটের কারণে সেই সময় সেটা সম্ভব হয়নি। সেই জন্য এক মানবীকেই পুজো করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সেই সময় তিনি বাড়ির তৎকালীন বড় বৌমাকে বেছে নিয়েছিলেন পুজো করার জন্য। সেই থেকে আজও এই পরিবারে বাড়ির বড় বৌমাকে মা কালী হিসেবে পুজো করার রীতি চলে আসছে।
পরিবারের বর্তমান বড় বউ হীরাবালা সাঁতরা গত ৩৮ বছর ধরে মা কালীরূপে পূজিতা হয়ে আসছেন এই বাড়িতে। সম্পর্কে তিনি রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামল সাঁতরার শাশুড়িও বটে। কালী পুজোর দিন তাঁকে দেবীর আসনে বসানো হয় এবং গলায় রক্ত জবার মালা ও কপালে রক্ত চন্দনের তিলক আঁকা হয়। পুজোর সময় স্বয়ং মা কালী যেন হীরাবালাদেবীর শরীরে ভর করেন। সেই জন্য তিনি কার্যত ঘোরের মধ্যে থাকেন এই সময়। প্রতিবছর কালীপুজোর দিন পুরোহিত তাঁকে দেবীরূপে পুজো করেন। স্বাভাবিকভাবেই নানা জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা জীবন্ত কালীর পুজো দেখতে আসেন এবং সাঁতরা বাড়িতে ভিড় জমান। হীরাবালা দেবী বলেন, ‘প্রায় ৩৮ বছর ধরে আমাকে দেবীর আসনে বসানো হয়। মায়ের ইচ্ছাতেই আমি পবিত্র ওই আসনে বসি। পুজোর সময় আমি বাস্তব জগত থেকে যেনও হারিয়ে যাই। অদ্ভুত এক অনুভূতি আমাকে ঘিরে রাখে। পুজোর পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হই।’
Discussion about this post