এই শস্যশ্যামলা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোণে কোণে লুকিয়ে ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস। তার সন্ধান পেলে কবিগুরুর ভাষায় বলাই যায়, “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া…!” তেমনই এক গ্রামের একটি প্রসিদ্ধ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী দুর্গোৎসবের কথা আজ আপনাদের জানাবো, যার সাথেও জড়িয়ে বহু বছরের ইতিহাস। তাছাড়াও উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হল, আড়বালিয়ার নীলকণ্ঠ কুঠির এই পুজো এ বছর পা দিল ২২৫ বছরে!
উত্তর ২৪ পরগণার বসিরহাটের কাছেই অবস্থিত এই আড়বালিয়া গ্রাম। এই গ্রামের নীলকণ্ঠ কুঠির পুজোর কথা বলতে গিয়ে তার ইতিহাস না জানালে বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ঠিক ২২৫ বছর পূর্বে এই গ্রামে পা রাখেন দরিদ্র ব্রাহ্মণ নীলকণ্ঠ ভট্টাচার্য ও তাঁর স্ত্রী প্রাণসুন্দরী দেবী। পরবর্তীতে নীলকণ্ঠ মহাশয় নাগবংশীয় জমিদারদের কুল পুরোহিত নিযুক্ত হন। নিঃসন্তান এই দম্পতি বংশ রক্ষার্থে পুত্র কামনায় ১২০৪ সনে রামনবমীর দিন প্রতিষ্ঠা করেন কৃষ্ণরাধার বিগ্রহ। তৈরি হয় মাটির চণ্ডীমন্ডপ। এই মন্ডপেই শুরু হয় দেবী দুর্গার আরাধনা। পরবর্তীতে ওই স্থানেই নির্মিত হয় ঠাকুর দালান, যেখানে বর্তমানে পুজো হয়। রাধাকৃষ্ণ ও দেবী দুর্গার প্রতিষ্ঠার ফলে নীলকণ্ঠ ভট্টাচার্যের বংশ শুরু হয়, এমনই বিশ্বাস ছিল তাঁদের। সেই ১২০৪ সন থেকেই নীলকণ্ঠ কুঠিতে দোল, দুর্গা পুজো, কালীপূজা, সরস্বতী পুজো ও নিত্যদিন রাধাকৃষ্ণের পুজো চলে আসছে।
প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো বড় ঠাকুর দালানের সামনে বছর ছয়েক আগে নির্মিত হয়েছে নাটমন্দির। দেবীর একচালা প্রতিমাই বরাবরের রীতি। বাড়ির সদস্যরাই পুজোর যাবতীয় কাজকর্ম সামলান। তবে বর্তমানে পরিবারের বাইরে থেকেই পুরোহিত ও তন্তধারককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। নীলকণ্ঠ কুঠির পুজোয় পালন করা হয় কিছু ব্যতিক্রমী আচার। যেমন, কুমারী পুজো করা হয় না এখানে। পাশাপাশি পশু বলি থেকে বিরত থেকে শাস্ত্রমতে সম্পন্ন হয় ছাগ বলি। ‘ছাগ’ শব্দের অর্থ ‘ষড়রিপু’, অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। কাজেই কুমড়ো, আখ ইত্যাদির বলির মাধ্যমে এই ষড়রিপুকে পরিত্যাগ করাই এই পুজোর রীতি। তবে শাক্তমতে পুজো হওয়ার কারণে নিরামিষ নয়, বরং ভোগে থাকে মাছ। গ্রামের প্রতিটি মানুষ এখনও আসেন এই ভোগ খেতে। পুজো শেষে বাড়ির পাশের পুকুরে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। আগে বিসর্জন হত নৌকায়। প্রথমে দুটো নৌকা পাশাপাশি রেখে মায়ের প্রতিমাকে নিয়ে যাওয়া হত জলে। তারপর নৌকাদু’টি দু’পাশে সরে যেত। কিন্তু হঠাৎ একটি বছরে কিছুতেই সরল না একদিকের নৌকা। বাধা পড়ল বিসর্জনে। তারপর থেকেই বদল ঘটে এই পুরনো রীতির। এখনও বিসর্জন ওই পুকুরেই হয়, তবে নৌকায় নয়।
স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা অনেকেই পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন। পুজোর রীতিনীতিতেও বদল ঘটেছে কিছু। তাতেও নীলকণ্ঠ কুঠির দুর্গোৎসবের জৌলুস কিন্তু ক্ষুণ্ণ হয়নি এতটুকুও। ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সেই বছর প্রকাশিত হয় একটি স্মারক গ্রন্থ। হাল আমলে থিমের পুজোর জাঁকজমকের আড়ালে যে হারিয়ে যায়নি গ্রাম বাংলার সাবেকি পুজোর পরম্পরা, তারই নিদর্শন এই নীলকণ্ঠ কুঠি!
Discussion about this post