কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতে আরও এক জাতি বা সম্প্রদায়ের কথা জানা যায়। তারা হল আর্মেনিয়ান। আর্মেনিয়ানদের কলকাতায় আগমন সতেরোশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। প্রথম ইউরোপীয় জাতি হিসেবে এ দেশে আর্মেনিয়ানরা এসেছিল পার্সিয়া, আফগানিস্তান, তিব্বতের পথ ধরে। প্রতিষ্ঠা করেছিল বাণিজ্য কেন্দ্র। ফলতঃ তাদের হাত ধরেই ভারতে খ্রিস্টান ধর্মের প্রবেশ। কলকাতায় আসা আর্মেনিয়ানরা প্রত্যেকেই ছিলেন খ্যাতনামা ধনী ব্যবসায়ী। খুব দ্রুত তাঁরা এ শহরে গড়ে তোলেন নিজেদের উপনিবেশ, একাধিক বাড়ি, স্কুল, চ্যাপেল। ১৬৮৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁদের জন্য বানিয়ে দিয়েছিল একটি ছোট কাঠের চার্চ, বর্তমান চার্চটির দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। ১৭০৭ সালে এক বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে যায় সেটি। তারপর ১৭২৪ সালে জনৈক আগা জ্যাকব নাজারের উদ্যোগে তৈরি হয় আজকের ‘আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অব নাজারেথ’।
১৭৩৪ সালে হাজারমল পরিবারের অনুদানে তৈরি হয় ক্লক টাওয়ার সহ ঘন্টা ঘরটি। এই পরিবারের বহু সদস্যের সমাধি রয়েছে চার্চ সংলগ্ন জমিতে। আসলে এই জমিটি ১৭২৪ সালের আগে পর্যন্ত সমাধিক্ষেত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হত। জমি দিয়েছিলেন কেনানেনটেক ফানুস। স্থপতি ছিলেন ইরানের গ্যাভন্ড (মতান্তরে হেভন্ড বা কাভন্ড)। অন্দর সজ্জার পরিকল্পনা ছিল ক্যাটচিক আরাকিয়েলের। ঘন্টা ঘরের ঘড়িটিও তাঁরই দান। বিভিন্ন ধনী আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীদের অর্থানুকূল্যে গড়ে উঠেছে মূল চার্চের বাইরের বাড়িগুলিও। তাঁদের মধ্যে একজন অ্যারাটুন স্টিফেন, কলকাতার সুবিখ্যাত গ্র্যান্ড হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক। মূল ফটকে প্রাচীন আর্মেনিয়ান হরফে যা লেখা আছে, তা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘পবিত্র মাতা নাজারেথ দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর হাত উন্মুক্ত প্রসারিত করে, তাঁর সন্তানদের অনুগ্রহের স্তন্যদুগ্ধে লালন করার জন্য।
১৬৮৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁদের জন্য বানিয়ে দিয়েছিল একটি ছোট কাঠের চার্চ, বর্তমান চার্চটির দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। ১৭০৭ সালে এক বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে যায় সেটি। তারপর ১৭২৪ সালে জনৈক আগা জ্যাকব নাজারের উদ্যোগে তৈরি হয় আজকের ‘আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অব নাজারেথ’। ১৭৩৪ সালে হাজারমল পরিবারের অনুদানে তৈরি হয় ক্লক টাওয়ার সহ ঘন্টাঘরটি। ১৭৯০ সালের পর আভ্যন্তরীণ কিছু সজ্জার পরিবর্তন ঘটানো হয়।
হোলি চার্চ অব নাজারেথের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই বাইরের কোলাহল মুখরিত শহর এক লহমায় যেন নীরব হয়ে যায়। প্রাচীন আম ও জাম গাছে ভরা শান্ত পরিবেশ। প্রার্থনা কক্ষের দুদিকের দেওয়ালের ওপরদিকে সারসার গথিক স্টাইলের রোজ উইন্ডোর মত গোলাকৃতি জানলা, বিশালাকার ফ্লুটেড গোলাকার থাম, মাথায় কাঠের কড়িবর্গার সঙ্গে স্টিলের জয়েস্ট। রিসেপশন হলের দক্ষিণ দেওয়ালে লাগানো একটি কালো পাথরের ফলকে আর্মেনিয়ান হরফে লেখা বেশ কিছু কথা। নিউ জুলফার অ্যারাটুন স্টিফেন তাঁর স্বর্গীয় পিতামাতা স্টেফান আর হান্না এবং ভাই মার্টিরোজের স্মৃতিতে ১৯০০ সালে চার্চের মেঝে সাদা-কালো মার্বেল পাথরে ঢেকে দেন।
১৯২৭ সালে ৬৬ বছর বয়সে মৃত খোদ অ্যারাটুন সাহেবও সমাহিত হন এই চার্চের প্রাঙ্গণেই। একটি সর্পাকার সিঁড়ি উঠে গেছে গ্যালারিতে, যেখানে দেওয়াল ফ্রেসকো ও পেইন্টিং-এ সুসজ্জিত। চার্চের বেদীতে রয়েছে একটি ক্রুশ, গসপেলের ভাষ্য আর বারোটি মোমদানি যা যীশু খ্রিষ্টের বারো জন দূতের প্রতীক। বেদী ইংরেজ শিল্পী এ ই হ্যারিস কৃত তিনটি অপূর্ব তৈলচিত্রে সজ্জিত – ‘হোলি ট্রিনিটি’, ‘লাস্ট সাপার’ এবং ‘দ্য এনশ্রাউডিং অব আওয়ার লর্ড’। চার্চের পূব দিকের দেওয়ালে আটকানো এক পিতলের ফলক থেকে জানা যায়, কারাপিয়েট বালথাজার ও হোসান্না বালথাজারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাঁদের সন্তানরা ১৯০১ সালের জুলাই মাসে চার্চকে এই তিনটি ছবি দান করেছিলেন।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – সলিল হোড়
Discussion about this post