বর্তমানে উপহারে, আনন্দে সজ্জিত হলেও সেকালের পয়লা বৈশাখ ছিল খাজনা আদায়ের বিভীষিকার মাস। পয়লা বৈশাখ দিনটির সাথে ‘শুভ’ যোগ শাস্ত্র বা বাংলা পঞ্জিকার কোথাও নেই বললেই চলে। আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই ছিল এই দিনটির উপস্থিতি। তবে এই দিনে সবচেয়ে আনন্দে থাকতো বাংলার শাসক ও জমিদারেরা। রাজস্ব কর আদায়ের শেষ দিন হিসেবে নির্ধারিত ছিল এই দিনটি।
বাংলা বছরের সূত্রধর কে ছিলেন তা নিয়ে বিস্তর মতাভেদ আজও বিদ্যমান। ঐতিহাসিকদের মতে বাংলার প্রথম সার্বভৌম সম্রাট শশাঙ্ক দেব ৭ম শতাব্দীতে তাঁর রাজত্বকালে প্রথম বাংলা বছরের সূচনা করেন। তাঁর সিংহাসনে আরোহনের দিন থেকেই গণনা শুরু হয় বাংলা বর্ষপঞ্জিকা বা বঙ্গাব্দের। যুগ পাল্টায়। প্রায় হাজার বছর পর মুঘল শক্তি আধিপত্য কায়েম করে বাংলার মাটিতে। আকবর মূলত রাজস্ব কর আদায়ের সুবিধার্তে বাংলা বছরের হিসেবে কিছু পরিবর্তন আনে। শস্য ফলনের সময় বিবেচনা করে বৈশাখের এই পয়লা তারিখেই প্রবর্তন করে ফসলি সনের। চৈত্র ও বৈশাখের এই সন্ধিক্ষণটি রুপ নেয় খাজনা মেটানোর তারিখ হিসেবে। মুঘল পরবর্তী ব্রিটিশ, বাংলার শাসক জমিদারদের কাছেও এই দিনটির ব্যবহারিক মাহাত্য ছিল এতটুকুই।
“বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না।” বিখ্যাত এই লাইনটি তখনকার বাংলার জমিদারদের প্রধান উপজীব্য। খাজনা আদায়ের আনন্দে একমাত্র তাঁদের কাছেই এটি ছিল বড় মধুর সময়। এই উদ্দেশ্যে বাংলা বছরের প্রথম দিনে অর্থাৎ বৈশাখের পয়লা তারিখে ঘটা করে পালিত হতো একটা গোটা উৎসব – রাজ পুণ্যহ(রাজকর আদায়ের উৎসব)। বলা বাহুল্য, প্রজাদের অর্থশোক ভোলাতে চোখের জলে ভেজা পুণ্যহর মধ্যে সুচতুর ভাবে মেশানো হত এই উৎসবের রঙ। উৎসবকে ঘিরে হতো মিষ্টিমুখ, থাকতো গান-বাজনা, যাত্রাপালা, মেলার আয়োজন। এসবই হতো প্রজাদেরই খাজনার পয়সায়। প্রজারা তখন ফেলে আসা বছরের বকেয়া খাজনা পরিশোধ করতে একপ্রকার বাধ্য। এই দিনই খাজনা মিটিয়ে জমিদারের কাছারি থেকে নতুন বছরের বন্দোবস্ত ছিল বাধ্যতামূলক। তাই নতুন হালখাতার পিছনে প্রছন্ন থাকতো প্রজাদের চোখের জলের নববর্ষ।
বাংলার মাটিতে তখন ‘পুণ্যহ’ আর বাংলা ‘নববর্ষ’ সমার্থক শব্দ। জাঁকিয়ে বসা এই রীতি একদিকে পূর্ণ করতো জমিদারি সম্পদ আর অন্যদিকে দীন প্রজারা হতো দীনতর। পুন্যহর মতো উৎসব প্রজাদের জীবনে গলার কাঁটা হয়ে বিঁধত ফি-বছর। পরবর্তীকালে নতুন আইন এলে সামাজিক ছবিটা পাল্টায়। ১৯৫০ সালে ইস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্টের অধীনে বাংলার মাটিতে জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটে। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় পয়লা বৈশাখের দিনে রাজ পুণ্যহ প্রথাও। ভাগশেষে রয়ে যায় খাওয়া দাওয়া আর উৎসবের অংশটুকু।
Discussion about this post