গ্রীষ্ম কিংবা শীত, শনি-রবিবার এলেই আমাদের মন কোথাও ঘুরতে যাবার জন্য আঁকুপাঁকু করতে শুরু করে। আর বেড়ানোর কথাই যখন এলো, তখন হাওড়ার থেকে ভালো জায়গা আর কী আছে? এখানে যেমন আছে বহু চেনা-অচেনা ট্যুরিস্ট স্পট, তেমনই জায়গাগুলিতে লুকিয়ে আছে নানারকম জানা-অজানা গল্প। ইতিহাসের এমনই কিছু রোমাঞ্চকর গল্পের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাওড়ার আন্দুল রাজবাড়ি। সে রাজাও নেই, আর সে রাজ্যপাটও নেই! তা সত্ত্বেও সহস্র স্মৃতি এবং ইতিহাসকে শিকড়ে আঁকড়ে ধরে বহু বছরের ঐতিহ্যকে বয়ে চলেছে আন্দুলের রাজবাড়ি। কলকাতা থেকে সড়কপথে, কিংবা হাওড়া থেকে ট্রেনে করেই পৌঁছে যাওয়া যায় আন্দুল। এখানেই আছে প্রকান্ড রাজমাঠের মাঝে রাজবাড়ি। রাজবাড়িটি জরাজীর্ণ, কিন্তু কোনোভাবেই ভগ্নপ্রায় না। বাংলার ‘জলসাঘর’ থেকে হিন্দির ‘সাহেব বিবি গোলাম’, বহু সিনেমার শুটিংও হয়েছিল এই বাড়িতে। শুধু তাই না, কয়েকমাস আগে এক মহিলা ক্রিকেটারের বায়োপিকের শ্যুটিং করতেও এখানে এসেছিলেন বলিউডের এক নামজাদা অভিনেত্রী।
ছবি – বিশ্বরূপ গাঙ্গুলী
বাংলায় যতগুলি রাজপ্রাসাদ আছে, তাদের মধ্যে আন্দুল রাজবাড়ী সবচেয়ে আলাদা! কেন? কারণ ষাট ফুট লম্বা এই প্রাসাদের সামনে আছে ৫০ ফুট লম্বা ডোরিক স্থাপত্যে তৈরি ১২টি স্তম্ভ, যা সারা বাংলার আর কোত্থাও নেই! এই জায়গাটি ছিল রাজবাড়ির নাচঘর, যেখানে বসত বাঈজীদের আসর। এছাড়াও বাড়ির ভেতরে ছিল ২০টি বাহারি স্তম্ভ, যেখান থেকে ঝুলতো বড় বড় ঝাড়বাতি। এর দুপাশে আছে তিনতলা বাড়ির অংশ। রাজপ্রাসাদের নাম ‘আনন্দ ধাম’, যার সামনেই আছে মূল ঠাকুরদালান, দুপাশে আছে সাতটি করে শিব মন্দির। এই মন্দিরে পূজিত হন দেবী অন্নপূর্ণা।
তবে এই পেল্লায় রাজপ্রাসাদ তৈরি করেছিল কে? ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় যে, প্রাচীন জমিদার দত্তচৌধুরী বংশের জামাতা ছিল মল্লিক পরিবারের। এই মল্লিক পরিবারের একটি শাখা আন্দুলে কর বংশের সূচনা করেছিল। এই কর পরিবারই পরবর্তীকালে নবাবের কাছ থেকে ‘রায়’ উপাধি লাভ করে। তো এই কর পরিবারের এক যুবক কপাল জোরে উকিলের চাকরি পান ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে। ইংরেজি, ফার্সি ও পার্সি জানা এই যুবক কিন্তু খুব কম সময়েই সাহেবদের মন জয় করে উকিল থেকে সোজা হয়ে গেলেন রবার্ট ক্লাইভের দেওয়ান! এই যুবকই হল রামচাঁদ কর, ওরফে রামচরণ রায়। একটা সময় তিনি ওয়ারেন হেস্টিংয়েরও দেওয়ানগিরি করতেন। এইভাবেই ২০ টাকা মাস মাইনের চাকরি করা এই যুবক একসময় বাংলার নবাব সিরাজউদদৌল্লার থেকে অগাধ সম্পত্তি লাভ করেন।
এরপর জমিদারি পান ওনার বংশধর রাজা রামলোচন রায়। এলাকায় নানা চিকিৎসালয় ও টোল খুলে জয় করে নেন এলাকার মানুষের মন। গভর্নর ভ্যান্সিটার্টের দেওয়ানগিরি থেকে শুরু করে ‘আন্দুলাব্দ’র চলন, রাজা নন্দকুমারের জালিয়াতি মামলা- সবেতেই তিনি জড়িয়ে থেকেছেন। লোকপ্রিয় এই জমিদার ১৭৬৬ সালে দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে পান ‘রাজা’ উপাধি, একটি ঝালর দেওয়া পালকি, আর প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা একটি কামান! ওনার বংশধর রাজা রাজনারায়ণ রায়ের হাত ধরেই তৈরি হয় আন্দুল রাজপ্রাসাদ। রাজবাড়ির আরেকটি বিশেষত্ব হলো দুর্গাপুজো। ২৫০ বছর ধরে চলতে থাকা এই রাজবাড়ীর প্রথম দুর্গা পুজোতে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং রবার্ট ক্লাইভ ! দিয়েছিলেন ১০০০০ টাকার সন্দেশ, ১০০০ টাকা প্রণামী এবং ১০৮ টি নীলপদ্ম।
এবারে চলে আসি স্বাধীনতার পরের গল্পে। সময়টা ১৮ থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি। আন্দুল রাজবাড়ি হয়ে ওঠে হাওড়ার কুখ্যাত ডাকাত হাঁদা মল্লিকের আস্তানা! ধনীদের কাছে এই ডাকাত ভয়ঙ্কর হলেও, গরিবদের কাছে ছিলেন রাজা! কারণ লোকের হাত,পা, মাথা কেটে যা গয়না পেতেন, সবই বিলোতেন গরিবদের মাঝে! ডাকাত হাঁদা মল্লিক গল্পের ‘রবিনহুড’কে বাংলার মাটিতে বাস্তব করে তুলেছিল এভাবেই ! আর লুটের মাল এমন এক জায়গায় লোকাতো, যা জানলে অবাক হতে হয়! আন্দুলের খটির বাজারের কাছে আছে একটি পুরোনো মিনার। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সরস্বতী ‘খাল’। এককালে এই মিনার ছিল সিমাফোর টাওয়ার, যার মাথা থেকে বর্গী হামলার সংকেত পাঠানো হতো। এই টাওয়ারের তলায় আছে এক সুড়ঙ্গ, যা রাজবাড়ির সাথেই যুক্ত! আর এই সুড়ঙ্গের মধ্যেই ডাকাত হাঁদা মল্লিক লুকিয়ে রাখতো দামি দামি গয়না, টাকা আরও কত কী!
ডাকাতির পাশাপাশি বাজির মালমশলাও তৈরি করতো হাঁদা মল্লিক। তার তৈরি মশলা দিয়েই মহালয়া থেকে দশমী অব্দি রোজ চলতো কামান। কামানের বিশাল শব্দে কেঁপে উঠতো গোটা আন্দুল আর তার আশেপাশের এলাকা। এই কামানের শব্দ শুনেই উলুবেড়িয়াতে শুরু হতো দেবীর বোধন। একসময় এই শব্দে রাজবাড়িতে ফাটল ধরতে শুরু করলো। তাই বন্ধ হলো কামানদাগা। বর্তমানে আন্দুল রাজবাড়ি পেয়েছে হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের তকমা। এখন সেখানে মিত্র পরিবারের বসবাস। পাশের সরস্বতী নদীর আজ ছিটেফোঁটাও নেই। তবুও ইতিহাসের এমনি অনেক অদ্ভুত গল্প আজও শোনাতে পারে আন্দুল রাজবাড়ি। শুধু শ্রোতার অপেক্ষা।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – প্লাবন দাস
Discussion about this post