দুর্গাপুজো মানেই শহর এবং শহরতলির বনেদি কিছু বাড়ির পুজো সামিল হবেই। সেরকমই হাওড়া জেলার অতি প্রাচীন এক বনেদি পরিবার, আন্দুলের জমিদার পরিবার। পরিবারে প্রথম দেবীর পুজো শুরু হল ১৫৬৮ সালে জমিদার রামশরণ দত্তচৌধুরীর আমলে। সেই সময়ে মাটির তৈরি দেবী মূর্তির পুজোই চালু ছিল জমিদার বাড়িটিতে। সিংহ ছিল ঘোটক মুখী। খড়ের আটচালাতেই হত পুজো। এমনকি পাঁঠাবলির প্রথাও চালু ছিল সেখানে। আন্দুলের মহিয়াড়ী অঞ্চলে বিশাল জমিদার বাড়ির পাশেই ছিল পুজোর স্থান।
১৬২৪ সাল নাগাদ শাহজাহানের কাছ থেকে পৈতৃক জমিদারির কিছু অংশের পুনরায় অধিকার দখল করেন জমিদারীর উত্তরাধিকারী কাশীশ্বর দত্তচৌধুরী। তখন সেখানে এক বিশাল অট্টালিকা এবং পাকা দুর্গা দালানও নির্মাণ করা হয়। তারপর থেকে বেশ শকিছু বছর সেই দালানেই পূজিতা হতেন দেবী দুর্গা। জমিদার পরিবারটির নামেই পরবর্তীকালে সাঁকরাইল থানা অন্তর্ভুক্ত আন্দুল গ্রামের উল্লেখ্য অঞ্চলটি ‘চৌধুরী পাড়া’ নামে পরিচিত হয়। তবে ১৯২৯ সাল নাগাদ ‘চৌধুরী দুর্গাদালান’টি ভেঙে পড়লে সে স্থানে পরের বছরই পাঁচ-খিলান ও দু’দালান বিশিষ্ট এক নতুন দুর্গা দালান নির্মিত হয়।
জন্মাষ্টমীর দিন মূল কাঠামোটির পুজো করা হয়। তবে আশ্বিনে দেবীর বোধন শুরু হয় কৃষ্ণনবমী তিথিতে। তা শেষ হয় দুর্গা নবমীতে। অর্থাৎ কল্পারম্ভ ও ঘট, পুজো শুরু ঠিক বারো দিন আগে থেকেই বসে যায় নিজের স্থানে। এ পরিবারে পুজো হয় বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ মতে। দেবীপক্ষ পড়লেই পরিবারের অবিবাহিতা মেয়েদের হাতে শাঁখা পরার নিয়ম থাকলেও নোয়া পরা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। পুজোর তিন দিনই অন্নভোগ দেওয়া হয় এখানে। তবে পুজোর প্রসাদের মধ্যে অন্যতম পুরীর বিখ্যাত গজা। পুরনো ঐতিহ্য মেনে প্রসাদ বিতরণের সময় বাড়ির সদস্যরা বলেন- “বাবা, রামশরণের কড়াই ধর”। অষ্টমীর দিন হয় কালো প্রদীপের আরতি। এছাড়াও তান্ত্রিক আচার মতে একই সঙ্গে ব্রাহ্মণ এবং অব্রাহ্মণ কুমারী পুজোও প্রচলিত এই পরিবারে।
আগে পাঁঠা বলি চালু থাকলেও বর্তমানে তা পুরোপুরি বন্ধ। তার বদলে নবমীর দিন আখ ও চালকুমড়োর বলি দেওয়া হয়। চালের পিটুলি দিয়ে মানুষের মত আকৃতি গড়ে ‘শত্রু বলি’র রেওয়াজও রয়েছে পুজোয়। এরপর ধীরে ধীরে বিজয়া দশমীর দিকে এগিয়ে চলেন মা। সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ির মহিলারা দেবীকে দেন ‘কনকাঞ্জলি’। আন্দুলের পাশেই অবস্থিত ঝোড়হাট গ্রামের রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকেরা দেবীকে কাঁধে করে আন্দুলের দুলেপাড়ায় শোভাযাত্রায় নিয়ে যায় সেদিন। যদিও দত্তচৌধুরী পরিবারের মহিলাদের সেখানে যাওয়া নিষেধ। বরং দুলেপাড়ায় দুলে উপজাতির মহিলারা দেবীকে বরণ করেন। তারপর শোভাযাত্রা করে দেবীকে আবার ফিরিয়ে আনা হয় চৌধুরী পাড়ায়। এরপর আসে বিসর্জনের পালা। বহুকাল আগে সরস্বতী নদীর তীরে পরিবারের নিজস্ব ঘাটে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হলেও, বর্তমানে ঠাকুর দালানের কাছের পুকুরেই দেবীকে বিসর্জিত করা হয়। বছরের পর বছর আন্দুলের এই বনেদি পরিবারে চলে আসছে আশ্বিনে দেবীকে বরণ করে নেওয়ার এই প্রথা। চলতি বছরে করোনা সতর্কতাকে মাথায় রেখে দত্ত চৌধুরী পরিবারে ফের মিলছে মায়ের দেখা।
Discussion about this post