পশ্চিমবঙ্গে যতগুলি টেরাকোটার কারুকাজ সম্বলিত একরত্ন মন্দির রয়েছে তার মধ্যে হুগলীর বাঁশবেড়িয়ার রায়বাড়ির অনন্ত বাসুদেব মন্দির নিঃসন্দেহে অন্যতম। এটি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি উৎসর্গীকৃত একটি পঞ্চরত্ন টেরাকোটার মন্দির। রাজা রামেশ্বর দত্ত ১৬৭৯ সালে এই মন্দির নির্মাণ করেন। একই স্থানেই পাশে অবস্থিত হংসেশ্বরী মন্দিরের জনপ্রিয়তার কাছে এই মন্দিরের জনপ্রিয়তা অনেকটাই কম। এর কারণ একটাই যে এই মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশাধিকার সবার থাকেনা। অপর একটি কারণকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সেটি হল হংসেশ্বরী মন্দির এক বিশাল জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে। তাই স্বাভাবিভাবেই এই মন্দিরটি লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে যায় বেশিরভাগ সময়। সেই জন্যই অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের নাম সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয় না। তবে বাংলার টেরাকোটা স্থাপত্যের ইতিহাসে তথা টেরাকোটা বিশেষজ্ঞদের কাছে, এটি একটি অমুল্য সম্পদ ও চর্চার বিষয়।
মন্দিরটি ইটের তৈরি চার চালা কাঠামোর উপরে। একরত্ন বিশিষ্ট এই মন্দিরটির শিখরের রত্ন বা চূড়াটি অষ্টকোণাকৃতি। এই চারকোনা মন্দিরের তিনদিকে রয়েছে তিন-খিলান শোভিত অলিন্দ। মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকার প্রবেশদ্বার দু’টি। যেখানে রয়েছে পাথরের তৈরি বাসুদেবের মূর্তি। চারহাত বিশিষ্ট এই মূর্তির হাতে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম এবং বাঁ দিকের কোণে নারায়ণ ও ডান দিকের কোণে লক্ষ্মী। হংসেশ্বরী মন্দিরের প্রবেশপথের ঠিক আগেই বাঁ দিকে রয়েছে এই বাড়ির প্রায় ধসে পড়া নহবতখানা। মন্দিরের পূর্বদিকে ভিত্তিবেদীর উপর একটি ব্যাসাল্ট ফলক আছে যাতে পুরোনো বাংলা হরফে কিছু শব্দ লক্ষ্য করা যায়– “মহীব্যোমাঙ্গ শীতাংসু গণিতে শক বৎসরে। শ্রী রামেশ্বর দত্তেন নির্ম্মমে বিষ্ণুমন্দিরং।” এর অর্থ হল মহী ১, ব্যোম ০, অঙ্গ ৬, এবং শীতাংসু অর্থাৎ চন্দ্র=১, এই হিসাব ধরে অংকের বামগতি অনুসারে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল ১৬০১ শকাব্দ, অর্থাৎ ইংরাজির ১৬৭৯ সাল।
মন্দিরটি অতি প্রাচীন হওয়ার ফলে কালের নিয়মে অনেকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও যা অবশিষ্ট আছে সেগুলির সৌন্দর্য ও শিল্পসুষমা চমকপ্রদ এবং বিশ্লেষণযোগ্য। এই মন্দির কোন মহান শিল্পীর হাতে গড়া সেটি জানা যায়নি। তবে টেরাকোটার কাজের একেকটা প্যানেলে যে অসামান্য পৌরাণিক ও সামাজিক চিত্রসমূহ তুলে ধরা হয়েছে তা দেখে খুবই কৌতূহল হয়। জানতে ইচ্ছে করে যে কোন ভাবনা থেকে এই মন্দির গড়ে তোলা হয়েছিল।
বর্তমানে মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে চলে এলেও, মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এখনও রাজবাড়ির সদস্যদের তত্ত্বাবধানেই রয়েছে। এই সমৃদ্ধশালী মন্দিরকে আরও বেশী করে রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং মানুষের কাছে এই মন্দিরের পরিচিতি বাড়ানোর বিশেষ প্রয়োজন। রাজা নৃসিংহদেব হংসেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়ই দেখেছিলেন বাসুদেব মন্দির ক্ষয় হচ্ছে। তাই তিনি পাথরের মন্দির বানাবার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর কত বছর কেটে গেছে। এখনো আমাদের চোখে এই মন্দির বাংলার অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় খানিকটা অক্ষত। তবে টেরাকোটার মন্দিরের সামাজিক গুরুত্ব যতটা তাকে রক্ষা করতে গেলে সরকার ও রায় পরিবার দুই তরফ থেকেই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ চালিয়ে যাওয়া খুবই জরুরী। তা নাহলে এই সুন্দর শিল্পকলা সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যাবে একদিন।
Discussion about this post