শীতের কাঠিন্য কাটিয়ে প্রকৃতিতে এখন রঙের ছোঁয়া কারণ বসন্ত এসে গিয়েছে। কৃষ্ণচূড়া আর রক্তপলাশের লালে প্রকৃতিও নতুন রূপে সেজেছে। এর মাঝেই আসে রঙের উৎসব, দোলযাত্রা। রোজকার একঘেয়ে জীবনযাত্রার জাঁতাকলে পড়ে আমাদের প্রত্যেকের জীবন প্রায় বিবর্ণই বলা চলে। তাই এই রঙিন উৎসবে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে মন চায় সব্বার।ধোয়ির ‘পবনদূত’ কাব্যে বর্ণিত অম্বুয়া নগরী বর্তমানে ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি ঐতিহাসিক শহর অম্বিকা কালনা নামে পরিচিত। বর্ধমান রাজাদের তৈরি অসংখ্য প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন মেলে এখানে। শ্রী শ্রী মহাপ্রভুর স্মৃতি বিজড়িত এই জায়গা বর্তমানে পর্যটন মানচিত্রে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে। অম্বিকা কালনার দোল এখানের এক অন্যতম উৎসব হিসেবে পরিচিতও বটে।

কালনায় দোলের আগের দিন সন্ধ্যায় রাজবাড়ী কমপ্লেক্সের ভেতরের রাসমঞ্চে চাঁচর উৎসব হয়। লালজী, কৃষ্ণচন্দ্র, বঙ্কুবিহারি, শ্যাঁমচাদ সহ আরও অন্যান্য যুগল বিগ্রহগণ দোল উপলক্ষ্যে মঞ্চে আসেন। এর পরদিন থেকে শুরু হয় দোল খেলা। ভক্তগণ যুগল বিগ্রহদের চরণে আবির দেন। তারপর ভোগ আরতির পর আবার বিগ্রহগণ পালকি চড়ে নিজের জায়গায় ফেরেন। দোল পূর্ণিমার রাতে রাজবাড়ী চত্বর এক মোহময় রূপ ধারন করে। ১৭৪০ সালে বর্ধমানের মহারাজ কীর্তিচাঁদ রায়ের জননী ব্রজকিশোরী দেবী লালজী মন্দির স্থাপন করেন। তিনি এক সন্ন্যাসীর কাছ থেকে লালজীকে পান এবং ছাপ্পান্ন ভোগের ব্যবস্থা করে লালজীকে প্রতিষ্ঠা করেন । সেই সময়ে রীতি অনুযায়ী ওই সন্ন্যাসীর সম্মানার্থে লালজিকে একটি পোড়া রুটি দেওয়া হত। আজ সেই রাজকীয় কৌলিন্য বা ভোগের প্রাচুর্যও কোনোটাই আর নেই । কিন্ত কালনাবাসীর কাছে লালজী অত্যন্ত আদরের ‘কালনার জামাই’। তিনি রাজার ঠাকুর তাই তাঁর নাম ‘লালজী মহারাজ জিউ’।

শ্যামচাঁদ জিউ বাড়ির অপর নাম মাঈজীর বাড়ি। ঠাকুর পদবীর মৈথিলী ব্রাহ্মণ ছিলেন তাঁরা। সেই সময় তাঁদের বংশেরই একজন ভক্তিমতি মহিলাকে সকলে ‘মাঈজী’ বলে সম্বোধন করত। তাদের অষ্টধাতুর যুগল বিগ্রহ ছিল। একটি পঞ্চরত্ন মন্দিরে সেবা পেত সেটি। বর্তমানে সেই বিগ্রহ অপহৃত হলেও মন্দিরটি আজও অক্ষত আছে। মাঈজী অকালে নিজের পুত্রকে হারিয়ে শোকে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন । তিনি নিত্য গঙ্গা স্নানে যেতেন ও পুত্রের জন্য বিলাপ করতেন। বর্ধমান রাজের পত্নী মহারানী সেই একই ঘাটে পাল্কি চড়ে গঙ্গাস্নানে আসতেন। পুত্রহারা জননীর কান্না শুনে তিনি মাঈজীকে রাজবাড়ীতে এনে সান্ত্বনা দেন। এরপর মহারানী মাঈজীকে বৃন্দাবন থেকে শ্রী শ্রী শ্যাঁমচাদের একক বিগ্রহ আনতে অনুরোধ করলেন। মাঈজী পায়ে হেঁটে শ্যামচাঁদকে নিয়ে আসেন। তারপর রাধারানীর সঙ্গে শ্যামচাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। সেই কারণেই শ্যামচাঁদকে বলা হয় লালজীর জামাই বলা হয়। তখন থেকে আজ অবধি কালনার রাজবাড়িতে মহা সমারোহে দোলযাত্রা পালিত হয়ে আসছে। শ্যামচাঁদ রাস ও দোল উৎসবে পালকি চড়ে রাজবাড়ীতে আসেন। প্রাচীনকালে তাঁকে মশালের আলোয় পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা হত, তবে হাল আমলে তা বন্ধ গেছে।

তথ্য এবং চিত্র ঋণ – কৌলাল
Discussion about this post