মানুষ আগুন আবিষ্কার করেছে প্রস্তর যুগে। পাথরে পাথর ঠুকে জ্বালানো আগুন আজ দেশলাইয়ের কাঠির দৌলতে হাতের মুঠোয়। আবার হিন্দু শাস্ত্র মতে আগুন অতি পবিত্র। পুজো করা হয় তাকে। কিন্তু শুধু তো আগুন নয়, উনুনকেও দেওয়া হয় যথেষ্ট সম্মান। এই উনুনেই যে শুরু হয় রোজকার লড়াই। পেয়ালায় চায়ে চুমুক দিতে দিতে যখন জম্পেশ নৈশভোজের সিদ্ধান্ত নিই, সেই তো ভরসা উনুনই। মানুষ উনুন ছাড়া ঘর বাঁধে না। সেই উনুনেরই পুজো। খাস আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই।
এই বাংলায় হেন ঋতু নেই, যেখানে নেই বিশেষ পূজো, আচার-অনুষ্ঠান। জন্মাষ্টমীর তালের বড়া যতদিনে শেষ হবে, শুরু হয়ে যাবে ‘আখা-পালনী’। ‘আখা’ অর্থাৎ উনুন, গ্রাম বাংলার ভাষা। এই উনুনেই রোজ রান্না চড়ে, সেদ্ধ হয় ধান। প্রতি ভাদ্র মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে মনসা এবং অগ্নিদেবতাকে তুষ্ট করতেই আয়োজন এই পার্বণের। উনুনে কোনরূপ আগুন জ্বালানো হয় না সেদিন। পূজোর দিন ভেতরের সমস্ত ছাই বের করে পরিষ্কার করা হয় উনুন। মোছা হয় গোবর জল দিয়ে। মূল সহ ধান গাছ এবং কচু রাখা হয় উনুনের ভেতর। উনুনে দেওয়া হয় সিঁদুরের তিনটে ফোঁটা। সাজানো হয় আলপনা দিয়ে। পুজোর দিন বাড়িতে উনুন জ্বলে না ঠিকই, তবে তার আগের দিনে সেরে নেওয়া হয় সমস্ত রান্নাবান্না। সারাদিনের খাদ্য বলতে আগের দিনের সেই রান্নাই। দই, কলা চিড়ে, মিষ্টি একসঙ্গে মেখে তৈরি করা হয় রাতের আহার। কোনো কোনো জায়গায় আবার মনসা দেবীর মাটির মূর্তি গড়ে পূজোর প্রচলনও আছে।
‘আখা পালনী’র পরদিন বাড়ির মেয়ে-বৌ’রা উনুন থেকে ধান-কচু গাছ তুলে পুকুরে বিসর্জন দেন। গোবর জল দিয়ে ফের মোছা হয় উনুন। উনুনে রান্না চাপে আবার। এই অনুষ্ঠানের আমেজও যেন হারিয়ে গিয়েছে কোথাও সময়ের সাথে সাথে। মাটির উনুনের রান্না হয় না ঠিকই, তবে এখন গ্যাস ওভেনের যুগ। গ্যাস ওভেনে চাপানো হয় রান্না। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা, জীবনযাপনে এরকম বিশেষ আচার অনুষ্ঠান সম্পূর্ন রূপে পালন করা হয়ে ওঠে না। দায়ী অবশ্য কেউই নয়। ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ এর দৌড়ে এমনটাই হয়তো হওয়ার ছিল! তবে গ্রাম বাংলার স্তরে স্তরে এখনও অনুষ্ঠিত হয় এমন অনেক লৌকিক উপাচার। স্থান ভেদে বিশেষ গুরুত্বও রয়েছে প্রতিটির। আগামী প্রজন্ম হয়তো এসব জানবে না কিছুই। কালের নিয়মে এক সময় হারিয়ে যাবে এই রীতি নীতি। হয়তো হারিয়ে যাওয়ারই গল্প বলে যুগের অবসান!
তথ্য ঋণ – বিলুপ্তপ্রায় লৌকিক পার্বণ, কৌশিক বড়াল
Discussion about this post