দিল্লি, আগ্রা তথা গোটা ভারত জুড়েই রয়েছে মোঘল সম্রাটদের স্থাপত্যের নিদর্শন। ইতিহাসের পাতা উল্টালেই পাওয়া যায় তাঁদের নানা কীর্তির বর্ণনা। তবে ‘মোঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক’ বলতেই উঠে আসবে একজনের নাম। তিনি হলেন বাদশাহ আকবর। শিল্প-সংস্কৃতির পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে ছিলো তাঁর গভীর অনুরাগ। তিনি ছিলেন ‘দীন-ই-ইলাহি’র প্রবক্তা। ইসলামের পাশাপাশি অন্য ধর্মের প্রতিও তিনি আকর্ষিত হয়েছিলেন।
আকবরের রাজত্বে দেশে জেসুইট পাদ্রিদের আগমন ঘটে। তারা গোয়ায় আসে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। এই বার্তা সুলতানের কাছে পৌঁছয়। তিনি এরপর পাদ্রিদের ডেকে পাঠান নিজের সভায়। তাঁদের মুখে ধর্ম ও সংস্কৃতির কথা শুনে তিনি খুবই আকৃষ্ট হন। আকবর সিদ্ধান্ত নেন আগ্রার পাশেই ওয়াজিরপুরে, এক আর্মেনীয় বসতিতে একটি গির্জা স্থাপন করবেন।এরপরই শুরু হয়ে যায় গির্জা তৈরির কাজ। হলুদ ও সাদা রঙের চার্চটি আজও দাঁড়িয়ে আছে মোঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসাবে। ১৫৯৮ সালে চার্চটি প্রতিষ্ঠিত হয়, নাম দেওয়া হয় ‘চার্চ অফ পিয়েটা’ যা ‘আকবরের গির্জা’ নামে পরিচিত। “সত্য সেলুকাস,কি বিচিত্র এই দেশ!” একেবারেই সত্যি। আমাদের দেশ বিচিত্র। এক মুসলিম শাসক হয়ে উঠলেন এক চার্চের প্রতিষ্ঠাতা।
পরবর্তীকালে মোঘল বংশের অনেকেই খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হন। শুধু আকবর নন বাদশাহ জাহাঙ্গীরও এই গির্জার সংস্কারের জন্য বহু অর্থ দান করেছেন। ১৬১০সালে দানিয়াল মির্জার পুত্র সহ জাহাঙ্গিরের তিন ভাইপো খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। যদিও পরে আবার তাঁরা ধর্ম ত্যাগ করেন ও মুসলিম ধর্মে দীক্ষা নেন। কিন্তু জাহাঙ্গিরের পুত্র শাহজানের সময়কাল থেকে খ্রিষ্টান পাদ্রিদের সাহস ক্রমশ বাড়তে থাকে।এই সময় শুরু হয় শাহজাহানের সাথে পর্তুগিজদের যুদ্ধ। পাদ্রিদের প্রতি বিরক্ত হয়ে সম্রাট তাদের বন্দি করে নেন। ক্ষুব্ধ হয়ে ভাঙতে থাকেন চার্চ এবং ‘আকবরের গির্জা’তেও এর প্রকোপ পড়ে! অবশ্য পরে পাদ্রিরা ক্ষমা চাইলে বাদশাহ নিজেই আবার সেই গির্জা পুননির্মাণ করেন। কিন্তু এখানেই শেষ না। বহু ঝড়ের মুখমুখি হতে হয়েছে এই গির্জাকে। ১৭৬১ সাল,পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ শেষ। দেশে শুরু ভয়ঙ্কর অরাজকতার। গোটা দেশ জুড়ে চলছে ধ্বংসলীলা। ভেঙে ফেলা হচ্ছে একের পর এক মন্দির,গির্জা,স্থাপত্য। বাদ গেলো না এই চার্চও। এই সময়,এক ইউরোপীয় ওয়াল্টার হেনহার্ট নামের ব্যক্তি এই গির্জার মেরামত ও সংস্কার করেন।
বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই গির্জার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে। দেখতে দেখতে গির্জার বয়েস হয়েছে প্রায় চারশো বছর। বৃদ্ধ হয়েছে,ভারতের ইতিহাসের অন্যতম নিদর্শন এই চার্চটি। কত কিছু দেখল,কত জন এলো গেল,কত কিছুই না সইলো। তবুও আজও গৌরবের সঙ্গে টিকে রয়েছে সে। এই স্থাপত্যের কাহিনী ইতিহাসের বইয়ে না পাওয়া গেলেও, এর অস্তিত্ব উপেক্ষা করা যায় না।
Discussion about this post