নাম তাঁর ঐশ্নিকা পাল, ধাম সল্টলেক। কলকাতার এক স্কুলে ক্লাস থ্রি’র পড়ুয়া সে। শুনতে খুব স্বাভাবিক লাগছে না! কিন্তু সমাজের চোখে যে সে ভীষণ অস্বাভাবিক। তাঁর দিকে নজর পড়লে আমরা তাকাই ভুরু কুঁচকে। কারণ! কিছুটা এতক্ষণে মনে হয় আঁচ করতে পেরেছেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঐশ্নিকা জন্মলগ্ন থেকেই আক্রান্ত মোজেক ডাউন সিনড্রোমে। হতেই পারে মানুষ এ জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী। এদিকে কী মজার কথা দেখুন, আমরাই আবার রাস্তায় ঐশ্নিকাদের দেখি ব্যঙ্গের চোখে। আসলে ভুলে যাই বিচ্ছিন্ন দ্বীপপুঞ্জেও ফোটে ফুল।
এই ঝাঁ-চকচকে কেতাদুরস্ত সভ্যতায় আমরা সবসময় খুঁজে চলি ‘বেটার লুক’। এরকম সন্তান আসলে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। সত্যিই কি তাই? নাকি ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত সন্তানকে নিয়ে যে জীবনযুদ্ধ, সেটাকেই ভীষণ ভয় পাই। বাস্তবটা বুঝতে ডেইলি নিউজ রিল পাড়ি দিয়েছিল সল্টলেক, কলকাতা ৬৪ ঠিকানায়। পৌঁছতেই অমায়িক হাসি হেসে স্বাগত জানাল ঐশ্নিকা। তারপরেই অবশ্য মগ্ন হয়ে পড়ল তাঁর প্রিয় কার্টুনের দুনিয়ায়। ঐশ্নিকার মা সৌমিনী পাল জানালেন মেয়েকে নিয়ে কীভাবে রোজ যুদ্ধ করতে হয়। সেই যুদ্ধে প্রতিপক্ষ কখনও সমাজ তো কখনও আত্মীয়-স্বজন। আবার নিজের মনেও চলে যুদ্ধ। ওনার ভাষায়, “কাল মেয়েকে নিয়ে বিয়েবাড়ি যাবো, তাঁর জন্য আমি তৈরি তো? যদিও প্রতিবার হেরে যাওয়ার আগে মনে হয়, আরেকটা সুযোগ জীবনকে দিয়েই দেখি না।” এতক্ষণে অবশ্য ঐশ্নিকা তৈরি হয়ে পড়ল এবং উপহার দিল একটি নাচের পারফরম্যান্স। কতোটা ভালো নাচ সে শিখেছে তার থেকেও বেশি মুগ্ধ করল নাচের প্রতি তাঁর অসম্ভব নিষ্ঠা।
এদিকে সৌমিনী আলাপচারিতায় জানালেন আরও বেশ কিছু ভাবনা। তাঁর কথায়, “আমরা আর কতদিন? কাছের মানুষরা পরামর্শ দিচ্ছেন, পরবর্তী সন্তান নেওয়ার জন্য। কিন্তু সেও যে বড় হয়ে ঐশ্নিকাকে দেখবেই তার নিশ্চয়তা কোথায়? কাজেই আমরা চাই আমাদের মেয়ে শুধু সিলেবাসের শিক্ষা নয়, জীবনের শিক্ষাতেও আলোকিত হয়ে উঠুক। এমন একটা দুনিয়া বানিয়ে যেতে চাই যেখানে ওর মতোই যারা একইভাবে লড়ছে জীবনের সাথে। তাদেরকে নিয়েই ঐশ্নিকা এক ছাদের নিচে বাঁচতে পারে। সেটা ঠিক কীরকম? সেই উত্তর অবশ্য মিলল ঐশ্নিকার বাবার কাছে।
বিরোজিত পাল, ক্যালকাটা ৬৪-এর পার্টনার এবং সোলফুল স্টেপসের চেয়ারম্যান। মূলতঃ তাদের মেয়ের কথা ভেবেই তারা তৈরি করেন সোলফুল স্টেপস, যেটি কোনভাবেই টিপিক্যাল এনজিও নয়। ডাউন সিনড্রোম এবং স্পেশ্যাল নিড বাচ্চাদের জন্য সেখানে চিকিৎসা পরিষেবা ও নাচ সেখার সুন্দর বন্দোবস্ত রয়েছে। শুধু সেখানে উপকৃত হয়ে চলেছে তিলোত্তমার আরও ঐশ্নিকারা। সৌমিনী পাল এবং বিরোজিত পাল আসলে তাদের মেয়েকে এভাবেই এক যৌথ বাঁচার স্বপ্নই দেখাতে চান। কীভাবে আপনার মেয়েকে অন্যদের সঙ্গে ইন্ট্রোডিউস করান? ডেইলি নিউজ রিলের এই প্রশ্নের উত্তরে বিরোজিত বলেন, সমাজ হয়তো মেনে নেবে না সেই ভয়ে প্রথম ২-৩ বছর আমরা মেয়েকে খানিক লুকিয়েই রাখতাম। এখনকার প্রচুর মা-বাবা তাদের ডাউন সিনড্রোম সন্তানকে সমাজের সামনে নিয়ে আসতে চান না। আমার নর্ম্যাল বেবি হলে যেভাবে সবার সঙ্গে আলাপ করাতাম, ঐশ্নিকার ক্ষেত্রেও সেটাই করি। তারপরেও কেউ অবাক চোখে তাকালে তাঁকে বিষয়টি নিয়ে সচেতন করি। ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে। ডাউন সিনড্রোমে ২১ তম জোড়ায় আরেকটি ক্রোমোজোম জুড়ে যায়। ফলে ৪৭ টি ক্রোমোজম নিয়ে কোষে একটি অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। এভাবে বোঝাই তাদের।
রাস্তায় বেরলেই তাদের দাগিয়ে দেওয়া হয় অ্যাবনর্মালের মত বিশেষণে। কোন ডাউন সিনড্রোম শিশুর সঙ্গে অন্য বাচ্চারা থাকলে তাদের অভিভাবক মারাত্মক চিন্তায় থাকেন এই ভেবে, আমার সন্তানকে আঁচড়ে কামড়ে দেবে না তো! কিন্তু ঐশ্নিকারা যে আসলে ভালোবাসার কাঙাল। এই একটি জিনিসই তাদের নরম মনের সঙ্গে খাপ খায়। তাই তো ঐশিকারা চেঁচিয়ে বলতে পারে, “হ্যাঁ, আমি ডাউন সিনড্রোম, তো কী হয়েছে?”
Discussion about this post