ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে করোনা নামক দস্যু। তার দাপাদাপিতে গত দু’মাস ধরে বন্ধ স্কুল-কলেজ, বন্ধ পরীক্ষাও। সম্প্রতি রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে আগামী জুলাই থেকে পরীক্ষার কথা। এই ঘোষণা হতেই একাধিক প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে পড়ুয়াদের মনে। পরীক্ষার বিরোধিতা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তৈরি হয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি সদস্যের #Againstexam নামক একটি গ্রুপ। তাদের দাবি পরীক্ষা বন্ধ করা হোক। ছাত্র-ছাত্রীদের পাশ করানো হোক আগের দু-বছরের পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে। কিন্তু এটা কি আদৌ কোনও সমাধান? কাজেই ‘ডেইলি নিউজ রিল’ সমস্যার সমাধান সূত্র খুঁজতে পৌঁছে গেল ছাত্র-ছাত্রী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকার দরবারে। চলুন শুনে নেওয়া যাক কী বলছেন তাঁরা।
প্রথমেই আসি #Againstexam গ্রুপের সদস্য কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এসসি গণিতের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র কুণাল ঘোষের কথায়। তিনি বলেন, পরীক্ষা কবে হবে বা কোথায় হবে এ সংক্রান্ত বিষয়ে সরকার এখনও পর্যন্ত কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি। এদিকে ইতিমধ্যেই ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন জানিয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বর থেকে নতুন বর্ষ শুরু হতে চলেছে। মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ আইআইটির মতো দেশের তাবড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আগের দু-বছরের পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে ও হোম অ্যাসাইনমেন্টের ভিত্তিতে গড় করে শিক্ষার্থীদের পাশ করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে এ রাজ্যের বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও কেন সেই একই পথে হাঁটছে না? তাছাড়া জুলাইতে পরীক্ষা হলে যে পড়ুয়াদের বাড়ি বহুদূরে তাদের থাকার জায়গা কে দেবে? সে নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। বহু সংখ্যক কলেজ রেড জোনে হওয়ায় করোনা সংক্রমণের আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। ‘ছাত্র জীবনের অন্যতম সেরা ভয় পরীক্ষা আর সেই পরীক্ষার ভয়ই কি পরীক্ষা বন্ধের মূল উদ্দেশ্য?’ আমাদের এই প্রশ্নের উত্তরে কুণাল জানান, লকডাউনের কারণে অনেকেই পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করতে পারেনি। কাজেই অনেককেই পরীক্ষায় বসতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হতে হবে। আবার পরীক্ষা যদি পিছিয়ে যেতে থাকে তাহলে ফলাফল বেরতে দেরী হবে। তাঁরা অন্য রাজ্যের পড়ুয়াদের থেকে পিছিয়ে পড়বেন অথবা বছর নষ্টও হতে পারে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.কম অনার্সের ছাত্রী মধুপর্ণা ঘোষের বক্তব্য একেবারেই অন্য। তার কথায়, পরীক্ষা ছাড়াই পাশ করানোর দাবিকে সে বা তার বন্ধুরা সমর্থন করে না। তার দাবি লকডাউনের জন্য পড়াশুনায় বিপুল ক্ষতি হয়েছে। আর এত বড় সিলেবাস অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে কখনোই শেষ করা সম্ভব নয়। বিশেষতঃ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্র্যাকটিক্যালের ক্লাস। তিনি আরও জানান, যারা এই পরীক্ষায় ভালো নম্বরের আশায় পড়াশোনা করছেন কিন্তু আগের পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েছেন, তাদের জন্য আগের পরীক্ষার গড় দেখে পাশ করানো অনুচিত হবে। তাই তার দাবি, পরীক্ষা এখনই না নিয়ে লকডাউন ওঠার পরে কলেজ খুললে তাদের কিছুটা সময় দেওয়া দরকার। তাতে তাদের পরীক্ষা আরও ভালো হবে।
আমরা কথা বলেছিলাম বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ মেমারি কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপিকা চেতনা মুখার্জীর সঙ্গে। তাঁর মতে, পরীক্ষা নেওয়া এবং পরীক্ষা একেবারেই না নেওয়া এই দুই ক্ষেত্রেই বেশ কিছু সমস্যা হতে পারে। পরীক্ষা না নিলে কখনোই সঠিকভাবে মেধার ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া সম্ভব নয়। যারা আগের পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়েছে তাদের ক্ষেত্রে হয়তো গড় করে নম্বর প্রদানের ব্যাপারটি সুবিধাজনক হবে। কিন্তু যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা আগের পরীক্ষাগুলিতে খারাপ নম্বর পেয়েছে কিন্তু এই পরীক্ষায় ভালো নম্বর তোলার জন্য পড়াশোনা করছে। তাদের জন্য এটি অবিচারই হবে। তিনি আরও জানালেন, অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে তাদের পড়াশুনা করানো হলেও তা কখনোই কলেজের ক্লাসের পরিপূরক হতে পারে না। এছাড়াও যে সমস্ত বিষয়ে প্র্যাকটিক্যাল রয়েছে সেক্ষেত্রেও হাতে-কলমে কাজ না শিখে পরীক্ষা দিতে গেলে শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়তে পারে। তিনি দাবি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর শিক্ষার্থীদের অন্ততঃ দু-মাস সময় দিয়ে তারপর পরীক্ষা নেওয়া উচিত। তাহলে শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাদেরকে পরীক্ষার উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারবেন। পাশাপাশি তিনি এও জানান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারের প্রতি তাদের পূর্ণ আস্থা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না যাতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হতে পারে।
সব দিক দিয়ে বিচার করলে উঠে আসছে একটাই কথা। সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন তা যেন এমন হয় যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করে। কোনও সিদ্ধান্তের কারণে যেন কোনও শিক্ষার্থীকেই সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয়। এটাই আমাদের কাম্য।
Discussion about this post