আবেশ দাশগুপ্তকে মনে পড়ে? ২০১৬ সালে যে কিশোরের মৃত্যু ঘিরে প্রায় তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল সারা কলকাতা! সেদিন ছিল ২৩ জুলাই। দশটি মেয়ে এবং ছ-টি ছেলে মোট ষোলো জন কিশোর কিশোরী জড়ো হয়েছিল এক বান্ধবীর জন্মদিনের পার্টিতে। সকলেই যে ঘনিষ্ঠ তা নয়। বেশির ভাগেরই অল্প কদিনের পরিচয়। কেউ কেউ আবার অচেনাও। এদের মধ্যেই একজন ছিল আবেশ। তবে সে কিন্তু নিমন্ত্রিতই ছিল না। একজন বন্ধুর সঙ্গে সে গিয়েছিল সেই পার্টিতে। সন্ধ্যে ছটা নাগাদ আবেশকে আহত অবস্থায় পাওয়া যায়, যেখানে পার্টি হচ্ছিল সেই বাড়িরই বেসমেন্টে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হয় তার। তদন্তে উঠে আসে নানা মোড় ঘোরানো তথ্য। এগারো-বারো ক্লাসের ওই সব কিশোর কিশোরী সেদিন সবাই প্রায় নেশায় চুর ছিল। এছাড়াও পার্টিতে মত্ত আবেশের শরীরে পাওয়া যায় ন’টি আঘাতের চিহ্ন।
সেইদিন সকালে আবেশ বেড়িয়েছিল মায়ের দেওয়া ১৮০০ টাকা নিয়ে। যদিও তার যাওয়ার কথা ছিল অন্য একটি পার্টিতে। অন্ততঃ তার ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবীর সঙ্গে তেমনই ছিল পরিকল্পনা। যে বন্ধুটি ওই কিশোরকে সানি পার্কের পার্টিতে নিয়ে গিয়েছিল, সে রক্তাক্ত অবস্থায় আবেশকে ফেলেই অসুস্থ মাকে দেখতে হাসপাতালে যাবে বলে তড়িঘড়ি বেরিয়ে যায়। যদিও সে হাসপাতালে যায়নি। ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে যাওয়ায় সোজা চলে যায় বাড়িতে। সেদিন আহত বন্ধুকে কেউই হাসপাতালে নিয়ে যাবার বন্ধুত্বটুকুও দেখায় নি। বেশ খানিকক্ষণ পরে পার্টির উদ্যোক্তা মেয়েটির বাবা তাকে নিয়ে যায় হাসপাতালে। সেদিন যা ঘটেছিল তা দুর্ঘটনা নাকি খুন, তা এখনও তদন্ত সাপেক্ষ। কিন্তু আমাদের চারপাশের অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর কিশোরীদের নেশার কবলে তলিয়ে যাওয়া, হারিয়ে ফেলা মূল্যবোধ, নেশার কারণেই নানান অপরাধে জড়িয়ে পরার ঘটনা ক্রমশই কিন্তু বেড়েই চলেছে। কলকাতার আনাচে কানাচে চোখ রাখলেই টের পাওয়া যায় অসুখ বাড়ছে। দেখা যাক সেই অসুখের বীজ কতখানি ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার বুকে।
তখনও তিলোত্তমার ভাগ্যাকাশে লেখা হয়নি লকডাউনের নিয়তি। সকাল সাড়ে দশটা। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভেজা পার্ক স্ট্রীটের অফিস পাড়ার ঘুম সবে ভাঙছে। আড়মোড়া ভেঙে দোকানগুলোর সাটার উঠে যাচ্ছে একে একে। রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়ার মাঝে ইতিউতি স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়ের দল। একটি হলুদ বাস এসে থামল পার্ক স্ট্রীটের নামী কনভেন্ট স্কুলের গেট থেকে একটু দূরে। হুল্লোড়ে নেমে আসছে ছেলে-মেয়েরা। শুধু দুটি মেয়ে পেছনের সিটে বসে, যেন একেবারেই তাড়া নেই তাদের। কোন ক্লাসে পড়ে তারা? বড় জোর ক্লাস নাইন। সতর্ক চোখে দেখছে স্কুল গেট। তারপর অন্যান্য ছেলে মেয়েদের সঙ্গেই বাস থেকে নামল তারা। সকলেই ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্কুল গেটের দিকে। এদিকে ধীরে ধীরে হাঁটার গতি কমিয়ে দিল মেয়ে দুটি। বাকিদের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে ঢুকে পড়ল পাশের গলিতে। গলিতে ঢুকেই চট করে পরনের আপারটা খুলে সটান চালান দিলো ব্যাগে। ভেতরে দিব্বি গোল গলা কালো স্কিনটাইট টি-শার্ট। গলি থেকে বেড়িয়ে রাস্তা পার করে উল্টো দিকে হাঁটা দিল তারা। স্কুল না করে কোথায় যাচ্ছে? স্কুল থেকে ঠিক দশ পা দূরে একটা ডাবওয়ালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো দুজনে। তেষ্টা পেয়েছে হয়তো।
চমক ভাঙলো ওদের কথা শুনে। “কাকু চিনি আছে?” ডাবওয়ালার কাছে চিনি! ব্যাপারটা কি? ডাবওয়ালা মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলো ‘কতটা’? একজন বলল ‘হাফ’। নীচের ঝোলা থেকে হাত ঢুকিয়ে ডাবওয়ালা বের করে আনলো নিজের মুঠো। তারপর গুঁজে দিলো মেয়েটির হাতে। মেয়েটিও মুঠোর মধ্যেকার জিনিসটা পার্সের ভেতর চালান দিয়ে বার করে আনলো চকচকে পাঁচশো টাকার নোট। গুঁজে দিলো ডাবওয়ালার হাতে। ডাবওয়ালার কাছে চিনি, যার দাম আবার ৫০০ টাকা! ততক্ষণে মেয়েদুটি আবার চলতে শুরু করেছে। এবার খানিকটা পা চালিয়েই। একটু এগিয়ে রাস্তা পার হলে ঠিক উল্টো দিকেই পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রি। মেয়ে দুটি ঢুকে গেল সেখানে। নির্জন কোণ বেছে বসল একটা মন্দিরের মত সমাধির ভেতর। চারদিক ভালো করে দেখে নিল তারা। নাহ! কেউ দেখছে না। কিন্তু ৫০০ টাকা দিয়ে ডাবওয়ালার কাছ থেকে চিনি কেনা, এই নির্জন সমাধির ভেতর জাঁকিয়ে বসা, এতো লুকোছাপাই বা কেন? খাবি তো এক মুঠো চিনি, তার আবার এতো আড়াল! ততক্ষণে তারা ব্যাগের ভেতর থেকে বার করেছে একফালি সাদা কাগজ আর টিফিনবক্স।
দেখলে মনে হবে বাদলা দিনে স্কুল পালিয়ে দুটি মেয়ে বোধহয় চড়ুইভাতি করছে। কিন্তু চমক তো এর পরেই। একটি মেয়ে সেই চিনির প্যাকেট ছিঁড়ে খানিকটা সাদা গুঁড়ো বন্ধ টিফিন বক্সের উপর পাতা কাগজে ছড়িয়ে দিল। দ্বিতীয়জন তখন বার করেছে কাগজ পাকানো একটা নলের মত জিনিস, আর একটা সিগারেটের প্যাকেট। প্যাকেট থেকে রাংতা বের করে ভাজ করে একটা শক্ত মত কার্ড বানালো মেয়েটি। তা দিয়ে সাদা পাউডারের মতো জিনিসটাকে সাজিয়ে তিনটে লাইন টানলো সে। হাতের নলটি বাড়িয়ে দিলো সঙ্গীকে। সঙ্গী মেয়েটি একটু ঝুঁকে পড়ে নলটি নাকে ঠেকিয়ে সেই লাইন টানা গুঁড়োর উপর অন্য প্রান্ত ধরে জোরে একটা লম্বা শ্বাস নিলো। হাতের তেলো দিয়ে নাক মুছে নলটি এগিয়ে দিলো অপরকে এবং সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ততক্ষণে প্রথম জন ধরিয়ে ফেলেছে একটি লম্বা সিগারেট।
ছবিটা এতক্ষণে যেন পরিস্কার হল। ওরা নেশা করছে। ওই চিনির গুঁড়ো আসলে হেরোইন। তবে এতক্ষণের ঘটে যাওয়া ঘটনাটি কিন্তু আগামী কোনও বাংলা সিনেমার স্ক্রীপ্ট নয়। আমাদের চারপাশে রোজ ঘটে যাওয়া বাস্তব কিছু ঘটনা। একবর্ণও কল্পনার আশ্রয় নেই, নেই কোন অতিরঞ্জন। খানিক পড়েই আলাপ জমানো গেল মেয়েদুটির সঙ্গে। টিউলিপ আর অস্মিতা (নাম পরিবর্তিত)। নামী কনভেন্ট স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্রী। “এই যে স্কুল বাঙ্ক করো বাড়িতে বা স্কুলে কেস খাও না?” “কামঅন ইয়ার, বোকা বোকা কথা বোলোনা তো। ওসব ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে। স্কুল কামাই করলে আজকাল কোন কেস নেই। মা কিংবা বাবার সই নকল করা তো জলভাত।” বলেই দু’বান্ধবীর হাই ফাইভ। কতদিন ধরে নেশা করছে প্রশ্ন করায় জানা যায় প্রায় এক বছর। কি ভাবে শুরু করলে? ওদের মুখেই শোনা গেলো সিনিয়র এক দাদার হাত ধরেই কবরখানায় প্রবেশ। তারপর হেরোইনের নেশা, যার বাজার চলতি নাম ‘চিনি’। এখন প্রায় নিয়মিতই চলে। বাড়িতে ধরা পড়ার ভয় নেই? নেশার টাকা জোগাড় হয় কি ভাবে? “ধুর বাড়ির লোকের এত টাইম কোথায়? মা পাপা দুজনেই বিজি। বাড়ী ফিরতে ফিরতে দশটা, ততক্ষনে আমি নিজের ঘরে। আর টাকা তো বাবা মা’ই দেয়। মাসে আমার পকেট মানি ৫ হাজার টাকা।” বলেই চকিতে ধেয়ে আসে প্রশ্ন, “এই তুমি এতো জেরা করছো কেন? তুমি কি পুলিশ?” তাদের নিরস্ত করা গেল। পুলিশ নয়, নেহাতই এক চাকুরে, বৃষ্টিতে অফিস যেতে ইচ্ছে না করায় ওদের মতই পালানো।
এত দাম দিয়ে রোজ নেশা করতে গেলে পাঁচ হাজারে কুলোয়? উত্তর আসে, কখনও বন্ধুরা খাওয়ায় বা দরকারে ঠিক জোগাড় হয়ে যায়। কি ভাবে? আরে কত বন্ধু একটু লাইন দিলেই টাকা দিয়ে দেয়। লাইন দিলে মানে? আমার হাতের সিগারেটটা ছোঁ মেরে নিয়ে অন্যজন বলে, তুমি কি গাম্বাট, লাইন বোঝো না! আরে ইয়ার ছেলে গুলোর সঙ্গে সামান্য স্মুচ করলেই টাকা দেয়। স্মুচ? হ্যাঁ স্মুচই, পাতি কথায় চুমু। নাহ! চমকাবেন না। এখন যে এটাই বাস্তব। সোশ্যাল মিডিয়ায় আবেশের মৃত্যু ঘিরে হয়েছিল তোলপাড়। কখনও পুলিশকে গালাগাল তো কখনও আবেশের বাড়ির লোককে। কিন্তু সমস্যার সমাধান কিন্তু আজও হল না। কারণ এ সমস্যা যে বেশ গভীর। যে তিমির সে তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। করোনা-মুক্ত কলকাতা যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, তখন নরকে যাওয়ার এই স্বর্গ-সুখকে কি আদৌ উপেক্ষা করতে পারবে টালমাটাল টিনএজ?
কলমে শুভেন্দু দেবনাথ
ঋণ – ভিন্নচর্চা
Discussion about this post