একাধারে তিনি বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ কর্মযোগী, ছাত্র দরদী শিক্ষক, স্বদেশব্রতী এবং প্রকৃতি প্রেমী। প্রেসিডেন্সি এবং সায়েন্স কলেজের এই অধ্যাপক ১৮৯০ সালে তৈরী করেন ‘নেচার ক্লাব’। ১৯০১ সালে ৮০০ টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’। গান্ধী দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেই স্বদেশ-ভাবনা থেকেই পরবর্তীকালে রচনা করেন ‘দ্য হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’। তাঁর গবেষণায় লাভবান হয়ে তৎকালীন ইংরেজ সরকার দিতে চেয়েছিলেন ‘নাইট’ উপাধি, কিন্তু তিলমাত্র আগ্রহ দেখাননি তিনি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় তিনি ‘আচার্য’। তিনি হলেন।প্রখ্যাত রসায়নবিদ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। আজ তাঁর ১৬০ তম জন্মবার্ষিকী।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রচিত ‘দ্য হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’ এককথায় একটি বিরল গ্রন্থ। ১৯০২ সালে প্রথম প্রকাশিত এই বইতে তিনি প্রমাণ করেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উন্নতির জন্য বিশ্ব কীভাবে ভারতের কাছে ঋণী। এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে তিনি ১৯০৮ সালে এই বইটির দ্বিতীয় খণ্ডও প্রকাশ করেন। এই কাজের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক সম্মাননা পান তিনি। তাঁর হাত ধরেই যেন ভারত জগৎসভায় লাভ করেছিল শ্রেষ্ঠ আসন।
প্রখ্যাত রসায়নবিদ এম বার্থেলট সহ অনেক বিজ্ঞানীই সেই সময় ভারতের প্রাচীন বিজ্ঞান চর্চা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ১৮৯৭ সালে বার্থেলট তাঁকে লন্ডনে ডেকে পাঠান। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই প্রফুল্লচন্দ্র রায় ভারতীয় রসায়ন নিয়ে লিখতে শুরু করেন। বইটির প্রথম অধ্যায় হল বেদে রসায়নের ধারণা। দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি আয়ুর্বেদিক যুগ এবং রসায়নের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন। তাঁর কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শাস্ত্রের ধারণা করা। এই বইতে তিনি বাগভট্টের কাজও অন্তর্ভুক্ত করেন। এই বইয়ের কিছু অধ্যায়ের কেবলমাত্র শিরোনাম থেকেই ভারতীয় প্রাচীন রসশাস্ত্র নিয়ে তাঁর গভীর অধ্যয়ন এবং ভারতের প্রাচীন বিজ্ঞানের গৌরবময় ইতিহাস অনুমান করা যায়।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রসায়নে জ্ঞানী ছিলেন, কিন্তু তাঁর সংস্কৃত ও বৈদিক সাহিত্যের জ্ঞান ছিল না। এই কারণেই তিনি এই গবেষণার জন্য সংস্কৃত পণ্ডিত শ্রীরাম নবকান্ত কবিভূষণের সহযোগিতা নেন। প্রকৃতপক্ষে, বেদে যজ্ঞের অর্থ শোধ এবং অনুসন্ধান। একইভাবে, বেদে তন্ত্র ও মন্ত্র বর্তমান সময়ে প্রচলিত উপপাদ্য এবং সূত্রের মতই ব্যবহৃত হত। পন্ডিত নবকান্ত কবিভূষণও রসায়নে জ্ঞানী ছিলেন না, কিন্তু তাঁরা একসঙ্গে ভারতের আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রাচীন রসায়নের উপর এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করতে সফল হন।
দুর্ভাগ্যবশত, পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি তো দূরের কথা, এই বইটি আজ মুদ্রিত আকারেই নেই। এর খুব কম কপি অনেক কষ্টে পাওয়া যায়। মাইসোরের গভর্নমেন্ট কলেজ অফ ইন্ডিয়ান মেডিসিন, যা দেশের অন্যতম প্রাচ্য গ্রন্থাগার, সেখানে রয়েছে এই বইয়ের কিছু সংস্করণ। আজ তাঁর প্রয়াণের এত বছর পরেও প্রশ্ন জাগে, বাঙালি সহ ভারতবাসী কতখানিই বা রক্ষা করতে পেরেছে তাঁর ঐতিহ্য?
Discussion about this post